হাওড়ার মুন্সির হাটের কিছু দূরেই রয়েছে জগৎবল্লভপুর, সেখানকার পাতিহালের এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম নিজবালিয়ায় রয়েছে দেবী সিংহবাহিনীর মন্দির। বাংলাজুড়ে বহু প্রাচীন কাল থেকেই দেবী সিংহবাহিনী পূজিত হন। হাওড়া জেলাতেও অসংখ্য সিংহবাহিনী মন্দির রয়েছে, তাদের মধ্যে নিজবালিয়ার সিংহবাহিনীই সবচেয়ে প্রাচীন। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল ও কবিশেখর বলরাম চক্রবর্তীর কালিকামঙ্গল কাব্যে এই দেবীর উল্লেখ রয়েছে। ষোড়শ শতকে কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চণ্ডীমঙ্গলে লিখে গিয়েছেন -
বালিয়ায় বন্দিলাঙ সিংহবাহিনী
অনাথ দেখিয়া দয়া কর্যাছে আপুনি৷
নিজবালিয়া গ্রামে নিজবালিয়ার বাজারের পাশেই সিংহবাহিনীর মন্দির রয়েছে। দুর্গাপুজোর সময়তেই এখানে দেবীর পুজো হয়৷ নিজবালিয়া প্রাচীন বালিয়া পরগণার অন্তর্গত ছিল। মনে করা হয়, এই এলাকায় বালি মাটির আধিক্যের কারণেই বালিয়া শব্দের উৎপত্তি। যদিও অধুনা বালিয়া অপভ্রংশ হয়ে বেলে নামে পরিচিতি লাভ করেছে। নিজবালিয়া নামের নেপথ্যে গবেষকদের আরেকটি তত্ত্ব রয়েছে। তাদের অনুমান, কোনও একসময় এলাকাটি কোনও এক ক্ষমতাধর রাজার খাস এলাকা ছিল। তা থেকেই নামের উৎপত্তি হয়েছে। জগৎবল্লভপুরের বালিয়া অন্ত সম্বলিত আরও কয়েকটি গ্রামের নাম পাওয়া যায়। যেমন গড়বালিয়া, নিমাবালিয়া, বাদেবালিয়া, যমুনাবালিয়া, বালিয়া-রামপুর, বালিয়া-ইছাপুর, বালিয়া-পাইকপাড়া, বালিয়া-প্রতাপপুর প্রভৃতি। মূলত গড়বালিয়া, নিজবালিয়া, যমুনাবালিয়া, বাদেবালিয়া এমন কয়েকটি গ্রাম নিয়েই ছিল বালিয়া পরগনা৷ আর সেখানকার অধিষ্ঠাত্রী দেবী, সিংহবাহিনী৷ এ সব অঞ্চল একদা বর্ধমানের রাজাদের আওতায় ছিল, তারও বহু আগে থেকে দেবী সিংহবাহিনীর দারুমূর্তি পূজিত হচ্ছে৷
দেবীর আবির্ভাব নিয়ে অজস্ৰ জনশ্রুতি রয়েছে। আনুমানিক পঞ্চদশ শতাব্দীতে নিজবালিয়া গ্রামে শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত জনৈক মনিরাম চক্রবর্তী বাস করতেন। তিনি সংসারী হলেও, বাড়ির সামনের এক প্রকান্ড নিম গাছের তলায় নিয়মিত যোগ সাধনা করতেন। এমনই একদিন সন্ধ্যায়, তিনি নিম গাছের তলায় বসে যোগ সাধনা করছেন। হঠাৎই এক রত্নাংলকারে ভূষিতা কিশোরীর দেখা পেলেন। ওই কন্যাটির কাছে পরিচয় জানতে চাইলে, কন্যাটি জানান, তিনি বর্ধমানের মহারাজার কন্যা, নায়েবের সঙ্গে তিনি বাবার জমিদারি দেখতে এসেছেন। কন্যাটি নিম গাছের তলায় বসলেন। ব্রাহ্মণ তার স্ত্রীকে ডাকতে গিয়ে, কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে দেখলেন সেই কন্যাটি নেই।
ওই একই দিনে একই সময়ে বর্ধমানের মহারাজা দেবীর স্বপ্নাদেশ পান। মনে করা হয়, ওই দিন দেবী সিংহবাহিনীই মহারাজার কন্যা গৌরীর বেশে নিজবালিয়া গ্রামে এসেছিলেন। স্বপ্নে দেবী মহারাজাকে জানান, মনিরামের বসতবাটি সংলগ্ন নিম গাছের তলায় তিনি বসেছিলেন। সেই নিম গাছের কাঠ দিয়েই যেন তাঁর মূর্তি তৈরি হয়। মায়ের আদেশ মতো মহারাজা নিজবালিয়া গ্রামের মধ্যস্থলে বিশাল মন্দির নির্মাণ করেন। মূর্তির কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর, দেবীকে প্রতিষ্ঠা করা হয়। গবেষকরা মনে করেন, মন্দরটি ষোড়শ শতকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠা ফলকে লেখা রয়েছে, " শ্রী রামনারায়ণ মারিক/সাং কলিকাতা সকাবদা ১৭১২সন/ ১১৯৭সাল/মাস অগ্ৰহায়ন।" দেবী সিংহবাহিনীর মন্দির দক্ষিণমুখী আটচালা এবং সামনে সংযুক্ত চারচালা দালান স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। মনিরাম চক্রবর্তীকে প্রধান পুরোহিত হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন মহারাজ। এর পাশাপাশি দেবীর নিত্য পুজোর জন্য সূপকার, মালাকার, কুম্ভকার, কর্মকার, গোয়ালা, ময়রা, জেলে, পরিচারিকা, ঢুলি বব্যস্থা করলেন মহারাজ। দেবীর নিত্য ভোগের মাছের জন্য মন্দিরের পাশে পুকুর খনন করালেন, মন্দিরের পাশেই বাজার বসালেন। দেবীর পুজার ব্যয়ভারের জন্যে ৩৬৫বিঘা জমি দেবী সিংহ বাহিনীর নামে দানও করেছিলেন মহারাজ। অন্য কিংবদন্তি অনুসারে, স্থানীয় কোনও এক ভূস্বামী রণসিংহ সিংহবাহিনী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ওই রণসিংহ বর্ধমান রাজ কৃষ্ণরামের দ্বারা পরাজিত ও নিহত হয়েছিলেন।
দেবী অষ্টভুজা, দেবী মূর্তির উচ্চতা প্রায় দেড় মিটার। মূর্তিটি নিমকাঠ দিয়ে তৈরি। তিনি কাঞ্চনবর্ণা, তিনি শ্বেত সিংহের উপর বিরাজ করেন। দেবীর ডান হাতে অসি, বাণ ও পাশ, এবং বাম হাতে ঢাল, ধনুর্বাণ, শঙ্খ। বাকি দুই হাতে দেবী বর ও অভয় দান করেন। দেবীর পিছনে চালচিত্রে নন্দীসহ মহাদেব এবং দুই দিকে দশমহাবিদ্যা ও বিষ্ণুর দশ অবতারের ছবি রয়েছে। দশ-বারো বছর অন্তর অন্তর দেবীর অঙ্গরাগ হয়। হাওড়া জেলার অন্যান্য সিংহবাহিনীর মন্দিরে দেবীর দশভূজা মূর্তি থাকলেও, এখানে তিনি অষ্টভুজা।
মূর্তিটি প্রাচীন দারুভাস্কর্যের অন্যতম সেরা নিদর্শন।
দেবীর নিত্য অন্নভোগ হয়, ভোগে মাছ থাকা আবশ্যক। দেবীর বাৎসরিক পুজো হয় সীতানবমী তিথিতে। রামনবমীর পর বৈশাখ মাসে এই তিথি পড়ে। সীতানবমীর তিন দিন আগে থেকে শুরু হয় চণ্ডীপাঠ। পুজার দিন কুড়িজন ব্রাহ্মণ সমবেত চণ্ডীপাঠ করেন। মায়ের বিশেষ পুজো, আরতি ও যঞ্জ হয়। সীতানবমী তিথিতে সকালে বহু মানুষ হেঁটে বাঁকে করে গঙ্গাজল নিয়ে আসেন। পুজোর পরদিন সিংহবাহিনী দেবীর অন্নকূট উৎসব হয়। নাট মন্দিরে দেবীর জিহ্বা সমতুল্য উচ্চতায় অন্ন রাখা হয় এবং ছাদ থেকে একটি ঘটিতে ঘি ভর্তি করে রাখা হয়। ঘটিটির তলায় ছিদ্র করা থাকে, সেখান থেকে ঘি অন্নের উপর এসে পরে। গ্রামবাসীদের উদ্যোগে ১৩৪৭ সনে অন্নকূট উৎসব শুরু হয়েছিল।
দেবীর পুজো উপলক্ষ্যে মেলা বসে। যাত্রা ও নানাবিধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। বালিয়াসহ পাশ্ববর্তী অঞ্চলে কোথাও দুর্গা পুজো হয় না, দেবী সিংহবাহিনী যেহেতু দুর্গাই ভিন্ন রূপ তাই এলাকার মানুষজন দুর্গা পুজোর কয়েকদিন মা সিংহবাহিনীকেই দুর্গা রূপে পুজো করেন। ৩০০ বছর আগে বর্ধমান রাজাদের হাতে পাতিহালের বর্ধিষ্ণু পরিবার, রায় পরিবারের দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল। রায় পরিবারের প্রতিমার মুখ নিজবালিয়ার সিংহবাহিনীর আদলে তৈরি করা হয়। দেবী এখানে চতুর্ভুজা রূপে সপরিবারে পূজিতা। আজও রীতি মেনে জন্মাষ্টমীর দিন সকালে রায়দের দুর্গা প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু হয়। একই পরিবার বংশানুক্রমে প্রতিমা তৈরি করে আসছে। কৃষ্ণনবমী কল্পে বোধনের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় চন্ডীপাঠ, দুর্গার দশ হাজার নামজপ, কৃষ্ণের পাঁচশো নামজপ হয়। পুজোর তিনদিন ও সন্ধিপুজোর দিন বলিদান হয়। অষ্টমীতে কুমারী পুজো ও নবমীতে হয় বিশেষ যজ্ঞ। আগে নবমীর দিন সকালে রায় পরিবারের তরফে সিহবাহিনীর মন্দিরে উপাচার দিয়ে আসা হত, তারপর মন্দিরে পুজো শুরু হত, তোপধ্বনির মাধ্যমে। সেই তোপধ্বনির আওয়াজ শুনে রায় পরিবারের নবমীর পুজো শুরু হত। এখন তোপধ্বনি না হলেও, নবমীর দিন আগে সিংহবাহিনীর মন্দিরে মায়ের পুজো হয়; তারপর রায় পরিবারের পুজো শুরু হয়।
দেবীর মন্দিরে সিংহবাহিনীর বাম দিকে কষ্টিপাথরের বিষ্ণু মূর্তি বাসুদেব জ্ঞানে পুজিত হচ্ছেন। ডানা ছড়ানো গরুড়ের ওপর প্রস্ফুটিত পদ্মাসনে দণ্ডায়মান রয়েছেন বিষ্ণু। বিষ্ণুর চার হাতে ধরা রয়েছে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম। বিষ্ণু মূর্তির উচ্চতা তিন ফুট, নানাবিধ অলংকার, মুকুটে ভূষিত তিনি।