ভক্তি যেখানে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার থেকেও গভীর সেখানে ভক্তরা সমস্ত ব্যাখ্যার উর্দ্ধে গিয়েই তাদের বিশ্বাস ও ভক্তিকেই প্রাধান্য দেয় বেশী। এরকমই এক নিদর্শন মেলে মথুরার বৃন্দাবনে। ছোট শহর হলেও এই বৃন্দাবনের খ্যাতি কিন্তু বিশ্বজোড়া, শ্রীকৃষ্ণের লীলাকাহিনী মোহিত করে তাঁর ভক্তদের। বৃন্দাবনে রয়েছে তাঁর একটি বিখ্যাত ধাম রংমহল যা নিধিবন নামক অরণ্য দ্বারা আবৃত।
এই দুটি নাম ভারতের রহস্যমন্ডিত দুটি নামের মধ্যে অন্যতম। নিধিবনের রহস্য হয়তো অনেকেরই অজানা, কিন্তু ভক্তরা যাঁরা জানেন তাঁদের মতে এটি শ্রীকৃষ্ণের লীলাখেলার প্রাণকেন্দ্র। যদিও বিজ্ঞান এর সত্যতা সম্পূর্ণভাবে যাচাই করতে এখনো পেরে ওঠেনি। তবে এখানে নিত্য ঘটে চলা ঘটনাগুলির কথা শুনলে বিজ্ঞানমনস্ক যে কেউও ভাবতে বাধ্য হবেন বৈকি!
এই ধাম সম্পর্কে প্রচলিত রয়েছে একটি কাহিনী, বলা হয় এই রংমহল অর্থাৎ রাধা-কৃষ্ণের মন্দিরে রোজ রাতে উপস্থিত হন স্বয়ং কৃষ্ণ। শুধু তাই নয়, তিনি প্রথমে অবতীর্ণ হন নিধিবনে যেখানে তিনি রাধিকা ও ১৬,১০৮ গোপীর সাথে লীলাখেলায় লিপ্ত হন। বলা হয়ে থাকে নিধিবনের গাছগুলি রাত হলেই গোপীদের রূপ ধারণ করে এবং রাধাকৃষ্ণের উপস্থিতিতে সেই অরণ্য অন্যরকমই হয়ে ওঠে। অবাক করার মতো ব্যাপার এই যে, নিধিবনে গাছের সংখ্যাও ১৬,১০৮টি যা পুরাণমতে কৃষ্ণের গোপীদের সংখ্যার সমান। নিধিবনে একটি কুঁয়ো রয়েছে, বলা হয় শ্রীরাধার তৃষ্ণা নিবারণার্থে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বাঁশির ব্যবহারে তৈরী করেন এটি। ভক্ত ও পূজারীদের মতে এই লীলাখেলার দরুন ক্লান্ত হয়ে গেলে বিশ্রামের জন্য রাধা-কৃষ্ণ উপস্থিত হন রংমহলে, যেখানে তাঁদের জন্য রাখা থাকে মিষ্টি, পান, দাঁতন ইত্যাদি। নিধিবনের দুটো দরজায় লাগানো হয় মোট আটটি তালা, যেখানে রাতে কারোর প্রবেশ নিষেধ। আর মন্দিরের এত কড়া ব্যবস্থাকে অতিক্রম করে বা অন্য কোনো প্রবেশদ্বারের মাধ্যমে রংমহলের মধ্যে কোনো মানুষের প্রবেশ করা সম্ভবপর নয়। অথচ প্রতিদিন সকালে মন্দিরের দরজা খুললে দেখা যায় অন্য এক ছবি। আহার হিসাবে যে লাড্ডু, পান ইত্যাদি আগের দিন সন্ধ্যারতির পর রেখে মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল সেই খাবার অর্ধেক খাওয়া, পান চিবোনো এবং দাঁতনগুলিও ব্যবহার করা। পূজারীরা বলেন, যে এটা স্বয়ং প্রভুর লীলা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই ঘটনার সত্যতা কতটা সেটা এখনো ধোঁয়াশাতেই রয়েছে, যা আছে তা হলো পুরোটাই বিশ্বাস।
নিধিবনের গাছগুলির রহস্যও নেহাত কম কিছু নয়। অন্য যে কোনো গাছের অনুরূপ এই গাছগুলির বৃদ্ধি আকাশের দিকে হয় না, বরং বেশি হয় ভূমির দিকে। এর সমস্ত ডালপালা বিস্তৃত হয় জমির আশেপাশেই, এটি গাছের সাধারণ প্রকৃতির একেবারেই বিপরীত। এমনকি এই নিধিবনের সংলগ্ন এলাকা অর্থাৎ বৃন্দাবন মথুরার অন্য কোন জায়গায় এই প্রজাতির গাছ দেখতে পাওয়া যায় না। এটা শুধুমাত্র নিধিবনেই পরিলক্ষিত হয়। সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে এই বনের সমস্ত বানর, ময়ূর ও পশুপাখি নিধিবন ছেড়ে অন্যত্র চলে যায় যেখানে তারা রাতে আশ্রয় নিতেই পারে নিধিবনে থাকা গাছগুলিতে। এমনকি নিধিবনের পাশে যাঁরা থাকেন তাঁরা তাদের বাড়ির যে সমস্ত দরজা জানালা বনের দিকে খোলে সেগুলি সন্ধ্যের পরেই বন্ধ করে দেন, আর রাত দশটার পরে তো কেউ তাকান ও না ঐদিকে। এরকমই একটা রীতি প্রচলিত সেখানে। নিধিবনে কখনো কাউকে রাতে থাকতে দেওয়া হয় না, তবে বলা হয় এমন মানুষও রয়েছেন যারা নিধিবনে সত্যিই শ্রীকৃষ্ণের অবতরণ হয় কিনা তা জানার জন্য লুকিয়ে থেকে গিয়েছিলেন রাতে। পরের দিন সকালে হয় তাঁদের মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে আর নয়তো তাঁরা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় পাওয়া গেছে যাদের দু এক দিনের মধ্যে মৃত্যু ঘটেছে।
নিধিবন সম্পর্কে যা কিছু শোনা যায় তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কিছুক্ষেত্রে দেওয়া গেলেও বেশিরভাগটাই রয়েছে অন্ধকারে। এই আলো-আঁধারি কাহিনীর ওপারে অন্য কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে কিনা তার উদ্ঘাটন করতে গেলে এর প্রতিটি তথ্যকে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। তবে শ্রীকৃষ্ণের এই লীলাখেলা যে নিতান্তই লোককথা নয় এর পিছনে যে একটা রহস্য ও কারণ রয়েছে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।