আমরা পৌঁছে গেছি একবিংশ শতকে। এগোচ্ছি আস্তে আস্তে সামনের দিকে। যত দিন যাচ্ছে, ততই প্রযুক্তিগত দিক থেকে উন্নত হচ্ছি আমরা। তৈরী হচ্ছে নিত্য নতুন প্রযুক্তি। যার ফলে আমরা যে কোনো কাজ অনায়াসেই করে ফেলতে পারছি। আজকের তথ্যপ্রযুক্তির দিনে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স সম্পন্ন হেল্পার বা স্মার্ট সহায়ক হল আমাদের হেল্পিং হ্যান্ড। গামছা কাঁধে বেয়ারা বা কোমরে শাড়ি গোঁজা কাজের মেয়েটি এখন অবলুপ্ত হতে চলেছে। আর দেশকে শিক্ষিত করে তুলতে এমনটাই দরকার। কেন মানুষ অন্যের বাড়িতে কাজ করে দিনযাপন করবে? সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন প্রকল্প আসছে গ্রামে গ্রামে। ১০০ দিনের প্রকল্পে আমাদের রাজ্যে বিভিন্ন রকম কাজ হচ্ছে, সেখানেই গ্রামের মানুষ বা শহরের দারিদ্রসীমার নিচে অবস্থিত মানুষেরা কাজ খুঁজে নিচ্ছে-এটা তো অর্থনীতির একটা ভালো দিক।
কিন্তু তাহলে আমাদের মতো মানুষদের কি হবে? তাছাড়াও বিভিন্ন অফিসে আজকাল কাজের ধরণ পাল্টে গেছে। তাই প্রয়োজন তাল মেলাতে পারা স্মার্ট হেল্পিং হ্যান্ড। সেই কারণেই শারীরিক অস্তিত্বহীন এই অ্যাসিস্ট্যান্ট শুধু গ্রাহকের কমান্ড মেনে কাজই করেনা, আগে থেকে বলে রাখা হুইপ যথাসময়ে সঠিকভাবে করে রাখে। নিজেদের কাজ হয়ে গেলে পরবর্তীতে আবার কোন কাজ করতে হবে, তা জেনে নেয় তার প্রভুর কাছ থেকে। এখানেই রয়েছে প্রযুক্তির খেল। কারন এই হেল্পিং হ্যান্ডেরা কিন্তু রক্তমাংসের ব্রেন নয়। প্রযুক্তি বা মাইক্রো চিপ দিয়ে তৈরী আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সির সাহায্যে এই হেল্পিং হ্যান্ডদের বানিয়ে নিতে হয়। এই আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সি বা কৃত্রিম মেধা (এআই)-কে নিজের বা সংস্থার প্রয়োজনমতো অর্থাৎ কি কাজে আমরা তাকে ব্যবহার করব, সেই মতো ডেটা দিয়ে চিপ তৈরী করতে হয়। তারপর তা মেশিনে দিয়ে দিলেই হল। কাজ করবে আপনার 'হুকুম মেরে আকা'। এই এআই নিয়ে বিজ্ঞানী, টেকনোক্র্যাটদের উন্নততর গবেষণা এবং সাফল্য সেই প্রযুক্তিকে আমাদের বর্তমান জীবনের সঙ্গে এক সারিতে জুড়ে দিয়েছে।
ইন্টারনেটের ব্যবহার, সেই ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। আজকের দিনে আমরা ঘুম থেকে ওঠা এবং ঘুমোতে যাওয়ার মধ্যে সর্বক্ষণ ইন্টারনেটের দুনিয়ায় থাকি। একটু জেনে নেবো, এই ধারণার প্রবর্তন কবে থেকে হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রারম্ভের সময় থেকেই এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পথচলা শুরু। যুদ্ধের সময় শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য দ্রুত প্রযুক্তিগত অগ্রগতির প্ৰয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সেই সময় ব্রিটিশ গণিতবিদ অ্যালান টুরিং এবং নিউরোলজিস্ট গ্রে ওয়াল্টার এই ধরণের মেশিন এবং তার সম্ভাবনা সম্পর্কে ধারণা দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি কোড ভাঙা খুব জরুরি হয়ে পড়েছিল। সেটা কিছুতেই পারা যাচ্ছিলনা। নিজস্ব বুদ্ধি দিয়ে তৈরী মেশিনের সাহায্যে তা করে দেখালেন টুরিং। ক্রিপ্টোলজি নিয়ে পড়াশোনা করা টুরিং 'ইউনিভার্সাল টুরিং মেশিন' নামে একটি হাইপোথেটিক্যাল যন্ত্র তৈরী করেন। এই মেশিনের আধুনিক রূপ-ই হচ্ছে কম্পিউটার। ১৯৪৮ সালে একটি ‘ইমিটেশন গেম’ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন টুরিং। এই টেস্টটির মূল উদ্দেশ্য ছিল অনুলিপিকরণ পরীক্ষা। পাশাপাশি দুটি রুমে একটিতে একজন মানুষ এবং অন্যটিতে একটি যন্ত্র রাখা হয়। ঠিক করা হয়, বুদ্ধিমত্তা কেন্দ্রিক বিভিন্ন প্রশ্ন লিখে পাঠানো হবে দুই রুমেই। কোনো শব্দ বা কণ্ঠের ব্যবহার করা হবেনা। যন্ত্রটি যদি মানুষের উত্তরের কাছাকাছি জবাব দিতে পারে, তাহলে বুঝতে হবে তার বুদ্ধিমত্তা আছে।
আমরা কিন্তু এখন প্রতিনিয়তই এই টুরিং টেস্টের সম্মুখীন হচ্ছি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্যাপচা রিকগনিশন করার সময় আমরা মানুষ না রোবট তা পরীক্ষা করা হয় এই টুরিং টেস্টের মাধ্যমেই। এরপর সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন কম্পিউটার ও কগনিটিভ বিজ্ঞানী জন ম্যাকার্থি আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শব্দটি ব্যবহার করেন। এআই প্রযুক্তির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তাকেই বলা যেতে পারে। আমাদের ইন্টারনেট সমৃদ্ধ স্মার্ট ডিভাইসগুলোতে এআই-এর ব্যবহার রমরমা।
আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সিকে মোটামুটি তিনভাগে ভাগ করা হয়। ১) উইক এআই- এই ইন্টেলিজেন্স শুধুমাত্র নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর কাজ করতে পারে। বর্তমানে আমরা এই ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করি। ২) স্ট্রং এআই- মেশিন বা কম্পিউটার যখন মানুষের মত কাজ করতে পারবে, তখন তাকে বলা হয় স্ট্রং এআই। ৩) সিঙ্গুলারিটি- এটা এমন একটা ইন্টেলিজেন্সি, যা সবচেয়ে প্রতিভাধর মানুষের ক্ষমতাকেও অতিক্রম করতে সক্ষম।
বিশেষজ্ঞদের একাংশ দাবী করেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষের থেকে ভাল পরিষেবা দিতে পারবে যন্ত্র। মানুষের অনেক কাজ করে দিচ্ছে তারা। নতুন প্রজন্মের বেশিরভাগই কিন্তু এখন গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট বা সিরিকে ব্যবহার করছে। এই প্রক্রিয়ায় চ্যাট করার সময় আর টাইপ করতে হচ্ছেনা। মুখে বলে দিলেই অ্যাসিস্ট্যান্ট লেখায় তা নিয়ে নিচ্ছে। বন্ধুর নাম বলে দিলেই সে ফোন ডায়াল করে দিচ্ছে। অ্যালেক্সা একটা গান শোনাও বললেই সে জিজ্ঞেস করে নিচ্ছে, কোন গান, কার গাওয়া ইত্যাদি এবং তারপর আমার পছন্দের গান শুনিয়ে দিচ্ছে।
স্মার্ট গাড়ি ও ড্রোন স্বয়ংক্রিয় তথা চালকহীন গাড়ির স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিয়েছে এই এআই। এই প্রযুক্তিতে তৈরী গাড়িগুলি নিজে থেকেই বুঝতে পারে, কখন ব্রেক কষতে হবে, কখন রাস্তার লেন বদলাতে হবে সর্বোপরি কিভাবে দুর্ঘটনা এড়াতে হবে। এছাড়া নিজ বুদ্ধির সাহায্য নিয়ে এই গাড়ি ঘুরতে এবং ম্যাপ ব্যবহারও করতে পারে।
আমরা যে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করি, কখনও ভেবে দেখেছেন, সেখানে আমাদের পছন্দের সব ব্যাপার কিভাবে আপনা থেকেই এসে উপস্থিত হয়? একটা নিজের পছন্দের স্ট্যাটাস দিলে তা ফোনের অ্যাপ নিয়ে নিচ্ছে সেই এআই পদ্ধতির মাধ্যমে। গ্রাহকের পছন্দ, অপছন্দ, ভালোলাগা সবকিছুই আমাদের লাইক-করার ওপর নির্ভর করে জেনে নিচ্ছে প্রযুক্তি। তার পর সেই মতো নির্দিষ্ট আপডেট পাঠাতে শুরু করে দিচ্ছে।
আপনারা কি লক্ষ্য করে দেখেছেন, ইউটিউব বা নেটফ্লিক্স ব্যবহার করার সময় পছন্দ মতো লিস্ট চলে আসছে আমাদের একটা কিছু শোনার বা দেখার পর পরপরই? তাও হচ্ছে সেই এআই পদ্ধতির মাধ্যমে। পাশাপাশি হাল আমলের জনপ্রিয় গেমগুলিও নিয়ন্ত্রিত হয়েছে এআই প্রযুক্তির দ্বারা।
অনলাইন বিজ্ঞাপন সেক্টরে এআই প্রযুক্তি উল্লেখযোগ্যভাবে কাজ করে। এক্ষেত্রে এআই শুধু ইন্টারনেট সার্চকারী ব্যক্তিদের ওপর নজর রেখে তথ্য তালাশ করে গ্রাহকদের পছন্দ-অপছন্দ বিচার করে সেই মত তাদের সামনে বিজ্ঞাপন হাজির করে। এইভাবে বিশ্বব্যাপী অনলাইন বিজ্ঞাপনের ব্যবসা হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
এভাবেই ব্যাংক পরিষেবা, স্মার্ট হোম ডিভাইস, অবজেক্ট রিকগনিশন, ফেস রিকগনিশন, অনলাইন কেনাবেচা সবই হচ্ছে এই এআই প্রযুক্তির সাহায্যে।
এই প্রযুক্তি দিন দিন যেভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডানা মেলছে, অনেক জায়গাতেই আশংকা করা হচ্ছে, এর ফলে বহু মানুষ কাজ হারাবে কি না। আসলে প্রথম যখন কম্পিউটারের চল শুরু হল, তখনও এমন আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, কারন প্রচুর মানুষের কাজ এক একটি কম্পিউটারই করে দিতে সক্ষম। কিন্তু যত দিন এগিয়েছে, সেই কম্পিউটার চালানোর মত প্রশিক্ষিত লোক তো দরকার। তাই কাজ হয়েছেও প্রচুর। এক্ষেত্রেও অবশ্যই এমনটাই হতে চলেছে। কারণ স্বয়ংক্রিয়তার ফলে যখন একটি নির্দিষ্ট কাজ দ্রুত, সহজ হয়ে যায়, তখন সেই কাজের বাকি দিকগুলি সম্পন্ন করতে প্রয়োজন হয়ে পড়ে আরও বেশি মানবসম্পদের। এ বিষয়ে প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈকত মিত্রের কথায় বলা যায়, এর ফলে যোগ্যতার মানোন্নয়ন হবে। সৃজনশীলতা বাড়বে। কমবে পণ্য উৎপাদনের খরচ। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হবে। স্বচ্ছতা বাড়বে। দেশের অর্থনীতির উন্নতি ঘটবে। নতুন ধরনের কাজ সৃষ্টি হবে। কায়িক পরিশ্রমের কাজের বদলে মেধা তথা কল্পনা, বুদ্ধিমত্তার ওপর নির্ভর করে মানুষ নিজের যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারবে। কাজের পরিধি বাড়বে। নিম্ন বা মধ্য দক্ষতার মতো ব্লু বা হোয়াইট কালার জব শেষ হয়ে যাবে। তৈরী হবে উচ্চ দক্ষতার কাজ। এই কারনে এই বছর থেকে সিবিএসই বোর্ড আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বিষয়টিকে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে চালু করছে অষ্টম ও নবম শ্রেণীর পড়ুয়াদের জন্য। নতুন প্রজন্মকে বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী করে তুলতেই স্কুল লেভেলে এআই চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলেই জানা গেছে বোর্ডের তরফে।