প্রকৃত আত্মবিশ্বাস ও অদম্য মনবল যে কোনো সৃষ্টিশীল কাজেই একটি অনন্য মাত্রা যোগ করে থাকে। সেভাবে ধ্বংস থেকে আবারও সৃষ্টি সম্ভব। আর মানুষ তা পারে। কারণ অন্যান্য প্রাণীদের তুলনায় মানব জাতির কাছে এখনো অনেক সম্ভাবনাময় সবকিছু। প্রকৃতি চিরকাল এভাবেই মানুষকে লালন করে এসেছে। যেভাবে সৃষ্টিকারী একটি উদ্দীপনাকে কেন্দ্র করে পৌঁছে যেতে পারেন সৃষ্টির মূল পর্যন্ত। সৃষ্টির এই আদি সত্তাটির সূত্র ও ছন্দগুলোকে আমরা ব্রহ্মান্ডের সবর্ত্র ছড়িয়ে থাকতে দেখতে পাই। এভাবে যেকোনো সৃষ্টিরই বিনির্মাণ সম্ভব। এবং এর মধ্যে দিয়েই সৃষ্টি আমৃত্যু বেঁচে থাকে।
সঙ্গীত রয়েছে প্রকৃতিতেই । আমাদের হাতের কাছেই যত সামান্য নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী অথবা বাতিল কোনো যন্ত্রপাতির অংশ দ্বারা চাইলেই একটি বাদ্যযন্ত্র নির্মাণ করা সম্ভব। কারণ প্রকৃতি তার সৃষ্টি এভাবেই করেছে। আদিম মানুষেরা যখন প্রথম সঙ্গীত খুঁজে পেলো, প্রতিটি আওয়াজ বা শব্দকে সচেতনতার সাথে আলাদা করে চিহ্নিত করতে শিখলো, সেই সময় থেকে আজকের এই সময় পর্যন্ত সঙ্গীত নিঃসন্দেহে মানুষের বিরাট একটা আবিষ্কার। আর সেই আবিষ্কারকে পাথেয় করেই নতুন কিছু সৃষ্টি-সম্ভাবনার একটি মোক্ষম রূপ দিয়েছেন পৃথ্বীরাজ বিশ্বাস নামে বছর ২৫'এর এক যুবক। বর্তমানে কলকাতার কেষ্টপুরের বাসিন্দা হলেও তার জন্মস্থান হুগলি জেলার শ্রীরামপুরে। সঙ্গীতের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক কিভাবে গড়ে উঠেছিলো.. সেই যাত্রাপথ, যন্ত্রাদির সঙ্গে তার সখ্যতা, ভাব বিনিময় -এসব আলোচনা চলাকালীন তাঁকে নানাবিধ প্রশ্ন করতেই তিনি সহাস্যে বলেন,
"ছেলেবেলা থেকেই আমার সঙ্গীতের প্রতি শ্রদ্ধা আর একটা আগ্রহ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। গ্রামেই ছোটোবেলাটা কেটেছে। সেখানে কবিগান থেকে শুরু করে বাউল গান, হিন্দি-বাংলা সব ধরনের গান বাজনাই শুনতাম আমি। ইচ্ছে হতো গাইতে। ২০১৫ থেকে আমি আমার সঙ্গীত জীবনে একটা নতুন অধ্যায় শুরু করি। মূলত খমক'ই বাজাই। এছাড়া ডুবকি, করতাল, একতারা বাজাতে ভালো লাগে।"
(নিজের বানানো বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে পৃথ্বীরাজ বিশ্বাস)
কিন্তু আপনি যেই যন্ত্রটি বানিয়েছেন, সেটা কিভাবে ব্যবহার করা সম্ভব?
পৃথ্বীরাজঃ মূলত একতারার কাজটা সুন্দর ভাবে করা যাবে এতে। অথবা কিছু ক্ষেত্রে একতারা বা দোতারার বিকল্প হিসেবেও ব্যবহার করা যেতে পারে এই যন্ত্র। এটা বাঁশ, বাঁশের টুকরো, কাঠ এবং তারের তৈরি খুবই হাল্কা একটা ইন্সট্রুমেন্ট। আর এতে বাঁশটাও অনেকটা বড় যেটা আমি চাইছিলাম। এই বাঁশটা আমি জোগাড় করেছি বেশ কিছুদিন আগে, আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে, ওর বাঁশের একটা দোকান আছে। বাদ্যযন্ত্র বানানোর উপযুক্ত বাঁশ পাচ্ছিলাম না। বাঁশ তো বিভিন্ন লটে আসতে থাকে, সবসময় পাওয়া যায় না। আমি ওর দোকানেই বসে থাকতাম। একদিন আমার পছন্দের বাঁশটা দেখতে পেয়েই ওর কাছ থেকে চেয়ে নিলাম। এর কোনো নাম এখনো ঠিক করিনি। যে যেটা ভালোবেসে ডাকবে এই যন্ত্রের নাম হয়তো সেটাই।
এটা সম্পূর্ণরূপে তৈরি হতে ঠিক কতটা সময় লাগলো?
পৃথ্বীরাজঃ বাঁশটা আমি পেয়ে গিয়েছিলাম, যেটা সবচেয়ে দরকার ছিল। ওটা দিয়ে প্রথমে একটা ‘খমক’ তৈরী হয়। কিন্তু সেটা বাজালে ‘প্রপার’ সাউন্ডটা ঠিক পাওয়া যাচ্ছিল না। তারপর নিজের মতো একটা পরিকল্পনা করে ব্যাপারটা শুরু হলো। ধাপে ধাপে এগোতে মোটামুটি ৪ থেকে ৫ দিন সময় লেগেছে এটা বানাতে। এখনও কাজ চলছে। কখনো সুতো লাগিয়ে পরীক্ষা করছি। স্ট্রিংগুলো চেঞ্জ করতে হচ্ছে এটা বুঝতে যে কোনটার কি আওয়াজ।
এই ভাবনাটা আপনি কোথা থেকে পেলেন? মানে এই জার্নিটার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছি..
পৃথ্বীরাজঃ একবার এক দাদার বাড়িতে গিয়েছিলাম। ওখানে ওনার একটা স্টাইল, প্যাটার্ন দেখেছিলাম বানানোর। আর এটা পুরোটাই মনের ব্যাপার। আমার একটা বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োজন ছিল। কিছু জিনিস ছিল আমার কাছে । আরো কিছু জোগাড় করে একত্রিত করার পর বাদ্যযন্ত্রটি সম্পূর্ণভাবে তৈরি হয়ে গেল।
বাদ্যযন্ত্রের নানারকম শ্রেণিবিভাগ রয়েছে। বাদ্যযন্ত্রের শ্রেণিবিন্যাস সম্পূর্ণ নির্ভরশীল সুরের কার্যকরি পাল্লা, গঠন-উপাদানের বৈশিষ্ট্য এবং নির্দিষ্ট আকারের উপর। পৃথিবীতে বেশকিছু জনবহুল অঞ্চলে বাদ্যযন্ত্রসমূহের স্বকীয়-উন্নতি হয়েছিল। বিভিন্ন সভ্যতার ভিতর যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হওয়ার দরুন অধিকাংশ বাদ্যযন্ত্র খুব দ্রুত মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং তাদের উৎপত্তিস্থল থেকে দূরবর্তী বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের ক্রমশ আলাপ ও পরিচয়ের সূত্রপাত।
মধ্যযুগীয় সময়কালে মেসোপটেমীয় কিছু বাদ্যযন্ত্রসমূহ প্রচলিত ছিল মূলত সমুদ্র তীরবর্তী দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে আর ইউরোপিয়ানরা বাজাতো উত্তর আফ্রিকান বাদ্যসমূহ। আমেরিকান অঞ্চলগুলোতে বাদ্যসমূহের উন্নতির গতি ছিল অত্যন্ত ধীর। কিন্তু উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকান সংস্কৃতি নিজেদের মধ্যে বাদ্যযন্ত্র ভাগ করে নিয়েছিলো। ১৪০০ সালের মধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বাদ্যযন্ত্রের উন্নয়নের গতি ধীরে ধীরে কমে যায় এবং পাশ্চাত্য বিশ্বের অধীনস্থ হয়ে পড়ে।
প্রথম যে যন্ত্রটিকে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে চিহ্নিতকরণ করা হয়, তার সময়কাল ও উৎস বিতর্কিত। সর্বপ্রাচীন যে বস্তুটিকে কিছু সংখ্যক পন্ডিত বাদ্যযন্ত্র হিসেবে নির্দেশ করেছেন, সম্ভবত একটি সাধারণ বাঁশি, যার বয়স আনুমানিক প্রায় ৬৭,০০০ বছর। এই বিষয়ে বিভিন্ন মানুষের একাধিক মত ও মতপার্থক্য আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রাচীন বাঁশিসমূহের বয়স অনুমান করা হয়েছে প্রায় ৩৭,০০০ বছর। তবে অধিকাংশ ইতিহাসবিদদের বক্তব্য, বাদ্যযন্ত্রের আবিষ্কারের সুস্পষ্ট সময়কাল খুঁজে বের করা অসম্ভব। কারণ, বাদ্যযন্ত্রের সংজ্ঞার প্রাসঙ্গিকতা ও বাদ্যযন্ত্র তৈরিতে ব্যবহৃত উপকরণসমূহের অনির্দিষ্টতা বাদ্যযন্ত্র সম্পর্কে সঠিক ধারণার অন্তরায়। অনেক প্রাচীন বাদ্যযন্ত্রসমূহই আগে বানানো হতো পশুর চামড়া, হাড়, কাঠ এবং অন্যান্য অস্থায়ী উপকরণ সহযোগে, যা এখনো কোনো কোনো বাদ্যযন্ত্রের ক্ষেত্রে একইরকমভাবে প্রযোজ্য।
বাদ্যযন্ত্র হল আসলে একটি উদ্ভাবন, যা এমনভাবে সংস্কার করা হয়েছে যার দ্বারা সুর বা সুর যুক্ত কোনও শব্দ সৃষ্টি করা সম্ভব এবং যাতে গানের সহায়ক হিসেবেও এটাকে ব্যবহার করা যেতে পারে, সেই দিকেও খেয়াল রাখা হয়েছে। অর্থগত দিক থেকে বিবেচনা করলে আমরা দেখতে পাবো, যেকোনো বস্তু যা শব্দ সৃষ্টি করতে পারে, তাকেই আমরা বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। বাদ্যযন্ত্র মানব সভ্যতার উদয়লগ্ন থেকেই প্রচলিত, শুধু সময়ের হাত ধরে তার রূপভেদ হয়েছে মাত্র। প্রাচীন বাদ্যযন্ত্রগুলো ব্যবহৃত হতো মূলত বিভিন্ন ধর্মীয় ও প্রথাগত আচার-অনুষ্ঠানে। ধীরে ধীরে সংস্কৃতির ক্রম বিকাশ হলে মানুষ বাদ্যযন্ত্রসমূহের যৌগিক ও মিলিত ব্যবহার শুরু করে বিনোদনের উদ্দেশ্যে। এই সময় থেকেই বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োগ ভিন্নতর হয়।
বাদ্যযন্ত্রের এই আবিস্কার খুব একটা বিরল ঘটনা নয়। বাংলা তথা গোটা দেশে সর্বোপরি আন্তর্জাতিক স্তরে নতুন ভাবনার সম্প্রসারণের ফলস্বরূপ নিত্য নতুন বাদ্যযন্ত্র নির্মাণের কাজ সর্বদাই চলছে। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যেটা মূলত ‘ফোক ইন্সট্রুমেন্ট’। হয়তো সবসময় তা এইভাবে প্রকাশ্যে আসে না। কিন্তু আবিষ্কার রেখে যায় তার নিজের পরিচয় আবিষ্কারকের মধ্যে।
[সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন অয়ন ঘোষ]