বর্তমানে আমাদের হাতে সময় অনেক কমে যাচ্ছে। নিজেদের কাজের পরিধি এতটাই বেড়ে গেছে, কাজের প্রয়োজনের বাইরে কিছুই প্রায় করা যাচ্ছেনা। বেশিরভাগ মানুষেরই তাই অবসর সময়ে পড়ার অভ্যেসটা চলে যেতে বসেছে। কিছু মানুষ যদিও বা ধরে রেখেছেন, তা তাঁরা বজায় রেখেছেন মোবাইলে ডাউনলোড করে নেওয়া বিভিন্ন আপ-এর মাধ্যমে পাওয়া বই থেকে। বছরে একবার বইমেলায় যদিওবা সময় বের করে যাওয়া সম্ভব হয়, লাইব্রেরি গিয়ে বই পড়ার তো সময়ই নেই কারোর কাছে।
এই ব্যাপারটিকে মাথায় রেখেই পশ্চিমবঙ্গ সরকার এক অভিনব উদ্যোগ নিল। আপনি চাইলেই এখন অবিভক্ত বাংলার ঔপনিবেশিক ইতিহাসের নানা অধ্যায়ের প্রতিটি খুঁটিনাটি তাঁদের ডেস্কটপ/ল্যাপটপ বা মোবাইল থেকেই ক্লিক করে দেখে নিয়ে পড়ে ফেলতে পারবেন। নবান্নের প্রশাসনিক উদ্যোগে মহাকরণের সেক্রেটারিয়েট লাইব্রেরির লক্ষাধিক দুষ্প্রাপ্য নথি-দলিল-বইয়ের সমাহারে গড়ে উঠেছে এক স্বয়ংসম্পূর্ণ ডিজিটাল গ্রন্থাগার। আপনাকে শুধু ক্লিক করতে হবে wbsl.gov.in।
প্রচুর অজানা এবং রোমহর্ষক ঘটনার সঙ্গে আমরা পরিচিত হতে পারব এই ডিজিটাল গ্রন্থাগারের মাধ্যমে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- পলাশীর যুদ্ধে সাত বছর পর থেকে সুন্দরবনের বিস্তারিত ইতিহাস, বিংশ শতকের প্রাক মুহূর্তে পুরীতে তীর্থযাত্রীদের উপকারের জন্য অতিথিনিবাসগুলিতে কর বসানো, মহম্মদ আলী জিন্নাহকে নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের প্রশংসনীয় মনোভাব, শ্যামনগরের চটকলে অস্থায়ী মহিলা কর্মীকে ছাঁটাই নিয়ে কর্মী বিক্ষোভে শ্বেতাঙ্গ ম্যানেজারের বাথরুমে গিয়ে লুকোনো, এক বছরে সুভাষচন্দ্র বসু-শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-মানবেন্দ্রনাথ রায়ের বিভিন্ন প্রান্তের খবর: প্রভৃতি অসংখ্য বিস্ময়কর তথ্য এবার সাধারণ মানুষের মুঠোর মধ্যে আসতে চলেছে। ইতিহাস, রাজনীতিবিজ্ঞানের ছাত্র-গবেষক-পন্ডিতেরা এই বিষয়গুলি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকলেও সাধারণ মানুষ যাঁরা রাজনীতি বা ইতিহাস সম্পর্কে জানতে আগহী, তাঁদের কাছে এই ডিজিটাল লাইব্রেরি এক সম্পদ হয়ে উঠতে চলেছে। এ ছাড়াও তৎকালীন ঔপনিবেশিক শোষনের ভয়াবহতাকেও আম জনতার সামনে মেলে ধরতে সক্ষম হবে এই ডিজিটাল লাইব্রেরি। ১৮৭১ সালের ৪ মার্চ প্রকাশিত ‘দ্য ক্যালকাটা গেজেট-এ’ লেফটেন্যান্ট গভর্নরের আসাম, কাছার ও শিলচরের চা বাগানগুলিতে শ্রম নিয়োগ সংক্রান্ত বেশ কিছু বিধিনিষেধ ও নির্দেশিকার নথি রয়েছে এই ডিজিটাল লাইব্রেরিতে। যাতে বলা হয়েছিল কর্মরত সাত থেকে বারো বছরের শিশুদের আধা পূর্ণবয়স্ক এবং বারো বছর ও তার বেশি বয়সী কর্মরত যে কেউ পূর্ণবয়স্ক বলে গণ্য হবে। তবে সাত বছরের কম বয়স্ক শিশু, বৃদ্ধ এবং যে কোনও বয়সের প্রতিবন্ধীকে কাজে নিয়োগ করা যাবেনা। রয়েছে ১৯৩৯ এ স্বরাষ্ট্র দফতরের রাজনৈতিক রিপোর্টে আই এফ-এ র সঙ্গে কলকাতার প্রধান তিনটি ফুটবল দলের ঝগড়া সামলাতে ফজলুল হক মন্ত্রিসভার তিনজন মন্ত্রীর হস্তক্ষেপ, ফ্রেডরিক ইডেন পার্সিপারগ ও এস ডি আসকলের দুটি আলাদা অসাধারণ গ্রন্থ রেভিনিউ হিস্ট্রি অফ সুন্দরবন, ১৭৬৫-১৮৭০ এবং ১৮৭০-১৯২০ বা উইলিয়াম হান্টারের ১৪, ১৩৬টি নথি ও চিঠি সম্বলিত চার খন্ডের বই(১৭৮২-১৮০৭)।
গত শুক্রবার নবান্ননের সভাঘরে মুখ্যমন্ত্রী ডিজিটাল লাইব্রেরিটি উদ্বোধন করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রাক্তন মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র প্রথম এই ডিজিটাল লাইব্রেরি গড়ে তোলার ওপর জোর দেন। এই লাইব্রেরির কাজ এগোনোর জন্য সরকারি স্তরে যে বিশেষ কমিটি গঠিত হয়, তার শীর্ষে ছিলেন তদানীন্তন সংস্কৃতি সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। এর পাশাপাশি মহাকরণ গ্রন্থাগারের প্রাক্তন গ্রন্থাগারিক ও সম্প্রতি ওএসডি হিসেবে কর্মরত বর্ণালী দত্ত গত পাঁচ বছর ধরে নিরলস পরিশ্রম করে এই প্রকল্পের সফল রূপায়ন ঘটিয়েছেন। তাই এবার থেকে আপনি চাইলেই পেয়ে যাবেন অতি মুল্যবান প্রচুর তথ্য, যা স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ের অজানা ইতিহাস তুলে ধরবে। পূর্বে ‘বেঙ্গল সেক্রেটারিয়েট লাইব্রেরি’ হিসেবে পরিচিত এই লাইব্রেরিটি ১৮৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়| ১৯২১ সালে এটি শিক্ষা মন্ত্রকের আওতাধীন হয় এবং ১৯৪৫ সালে এটি মুখ্যমন্ত্রীর সেক্রেটারিয়েট ডিপার্টমেন্টের অধীনে আসে| স্বাধীনতার পর এই লাইব্রেরিটিকে মহাকরণের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আওতায় আনা হয়| মুখ্যমন্ত্রী ড: বিধান চন্দ্র রায় গ্রন্থাগারটির উন্নতিসাধন করেন এবং আধুনিকিকরন ঘটান| এখানে প্রায় ২ লক্ষ বইয়ের(নথি- দলিল- বই সহ)সমাহার রয়েছে|