অল্পে তুষ্ট হওয়া ভোলানাথ আবার ভক্তের ভুলে ক্রুদ্ধও হয়ে ওঠেন। ঠিক যেমন হয়েছিল সুদর্শন ব্রাহ্মণের ক্ষেত্রে। হ্যাঁ, শিব পুজোয় ভুলবশত সুদর্শন ব্রাহ্মণের জীবনে নেমে এসেছিলো ভয়ঙ্কর অভিশাপ! তারপর কীভাবে সেই অভিশাপের থেকে মুক্তি ঘটলো তার? জেনে নিন শিব পুরাণের ' জ্ঞান সংহিতার' অন্তর্গত দ্বাবিংশতি অধ্যায়ে উল্লেখিত 'দধীচি ব্রাহ্মণের উপাখ্যান ও বটুক ব্রাহ্মণের উৎপত্তির' সেই কাহিনী।
দধীচি নামে অনেককাল আগে এক ধার্মিক ও বেদ পরায়ণ ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি ছিলেন পরম শিব ভক্ত। তিনি সকল যজ্ঞাদি কার্য করতেন এবং নিত্যনৈমিত্তিক কার্য সকল যথাবিধি অনুসারে সম্পন্ন করতেন। তাঁর পুত্রের নাম ছিলো সুদর্শন। সুদর্শনের দুষ্টকুলজাত স্ত্রী তার স্বামীকে বশীভূত করেছিল। তার চার পুত্র হয়েছিল। সুদর্শনও শিব পুজো করতেন। ব্রহ্মার মানসপুত্র দধীচি নিয়মিত শিব পুজো করতেন, কোন এক সময় তিনি বাড়ি থেকে একটি দূর গ্রামে গিয়েছিলেন। বাড়ি থেকে যাওয়ার আগে দধীচি তার পুত্রের ওপর শিব পুজোর ভার দেন। সেই রাত্রে কোন এক জ্ঞাতির সঙ্গে দেখা হওয়ার কারণে দধীচি আর বাড়ি ফিরতে পারেননি। এইসময় শিবপুজোর সময় উপস্থিত হওয়ায় দধীচির বাড়ির সকলে শিব পুজোর উপবাস করেন, দধীচি পুত্র সুদর্শনও সেদিন উপবাস করেন।
ভোরে শিব পুজোর আগে স্নান করেনি সুদর্শন। শুচিচার না মানায় তার জড়ত্ব প্রাপ্তি হয়। স্বয়ং ভগবান শিব আবির্ভূত হয়ে সুদর্শনকে ভৎর্সনা করে বললেন," হে দুষ্টু দধীচিপুত্র তুই অস্নাত হয়ে আমার পুজো করলি? তুই সব জেনেও যখন আমার পুজো করেছিস তখন তোর জড়ত্ব প্রাপ্তি হোক। রে পাপিষ্ট তুই আমাকে স্পর্শ করবি না। আমার দৃষ্টি থেকে দূর হয়ে যা।" ভগবান শিব এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই সুদর্শন জড়ত্বপ্রাপ্ত হল।
যথাসময়ে দধীচি ঘরে এসে সমস্ত কথা শুনে দুঃখে কষ্টে বিলাপ করতে শুরু করলেন। সুদর্শনের স্ত্রী সেই সময় পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হলো। দধীচি দুঃখ করে বলতে থাকলেন, "কুপুত্র আমার কুল নষ্ট করেছে।"
এরপর দধীচি দেবাদিদেব মহাদেবকে সন্তুষ্ট করার জন্য শিব পুজো করতে আরম্ভ করলেন। সুদর্শন তার মৃত পত্নীকে অভিশাপ দিল, "তুই পরজন্মে অসতী হবি"। দধীচি পুত্রের মঙ্গলের জন্য দেবী পার্বতীর নিকট পুজো করতে থাকলেন। দেবী পার্বতী সুদর্শন কে পুত্ররূপে স্বীকার করলেন, এরপর সুদর্শনও দেবীর পুজো করতে শুরু করলেন। দেবী পার্বতী তখন সুদর্শনের পুজোতে তুষ্ট হয়ে নিজে মহাদেবকে সুদর্শনের জন্য সন্তুষ্ট করতে যত্নবতী হলেন তিনি পুনঃ পুনঃ মহাদেবকে প্রণাম ও পুজো করে সুদর্শনকে তার ক্রোড়ে স্থাপিত করলেন এরপর সুদর্শনকে ঘি দিয়ে স্নান করিয়ে তাকে নিরাকৃত উপবীত ধারণ করালেন। সবশেষে তিনি সুদর্শনকে ষোড়শাক্ষর শিব গায়ত্রী উপদেশ দিলেন।
সুদর্শন 'ওঁ শিবায় নমঃ' মন্ত্রে ষোড়শবার জপ করে ষোড়শোপচারে বাদ্য সহকারে মহাদেবের পুজো করলেন। সুদর্শন যে পুজোর উপাদান দান করেছিলেন পার্বতী দেবী সেই সমস্ত উপাদান দ্রব্য মহাদেবকে গ্রহণ করতে অনুরোধ করলেন। মহাদেব তখন পার্বতীকে বললেন," আমার কাজে তুমি মুখ্য। বিশেষত দেবী কার্যে। তুমি যখন পূজিত না হবে সেখানে পূজোর ফল নিষ্ফল হবে। তুমি যেখানে থাকবে সেখানে আমার পুজো সম্পন্ন হবে।"
এরপর মহাদেব সুদর্শনের পুত্র চারজনকে অভিষেক করালেন এবং সুদর্শনকে উপদেশ দিলেন," তুমি বর্তুলাকার তিলক করবে। স্নান করবে। শিব সন্ধ্যা করবে এবং শিব গায়ত্রী জপ করবে। এই সব কাজ আগে করে পরে অন্যান্য কাজ করবে। বেদ মন্ত্র পাঠ করবে না, তোমার যোগ্য মন্ত্র পাঠ করবে। " এইভাবে দেবী পার্বতী ও মহাদেব সুদর্শনকে পুত্র বলে স্বীকার করে তার পুত্রকে বরদান করলেন তারপর বললেন তোমাদের মধ্যে একজন দুই পক্ষের সৈন্যদলের একপক্ষে যেখানে থাকবে সেখানে সেই পক্ষের জয় হবে। তোমরা যেখানে পূজিত বা সম্মানিত হবে সেইখানে আমি পূজিত হবো। হরপার্ব্বতী দ্বারা এই ভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করার ফলে এই চার ব্রাহ্মণ বটুক ব্রাহ্মণ নামে প্রসিদ্ধ হলো। তাই ব্রাহ্মন ভোজন কালে বটুককে ভোজন করালে অধিক ফল লাভ হয়।
শিব পুরাণ এ আরও উল্লেখিত আছে যে, অন্ধ কেশ্বরের সন্নিকটে একটি নগরে ভদ্র নামে এক রাজা ছিলেন, শংকর সেই রাজা কে একটি ধ্বজা দান করেছিলেন, এবং বলেছিলেন যে আমার পূজা কার্য ও প্রাজাপত্য ব্রত সম্পন্ন হলে প্রাতঃকালে এই ধ্বজা উত্থিত করে রাখলে রাত্রিকালে তা পতিত হবে। রাজা শিব পুজোর নিয়ম মেনে চলতেন তিনি প্রতিদিন শিব পুজো প্রাজাপত্য ব্রত অনুসারে সম্পন্ন করে নিয়মিত প্রাতঃকালে ধ্বজা উত্থিত করতেন। কোন একসময় রাজবাড়ীতে বটুক ভোজন করা হয়েছিল। রাজা বটুক ভোজন করিয়ে তাদের পাঠিয়ে দেওয়ার পর ব্রাহ্মণভোজন শুরু হয় কিন্তু ব্রাহ্মন ভোজন শেষ না হতেই ধ্বজাদন্ড পতিত হলো। তখন রাজা ব্রাহ্মণদের জিজ্ঞাসা করলেন," হে সত্যবাদী ব্রাহ্মণগণ আপনারা সত্য করে বলুন এমন অসময়ে ধ্বজা দন্ড পতিত হলো কেন? ব্রাহ্মণগণ তখন বললেন আপনি ব্রাহ্মন ভোজন এর আগে বটুক ভোজন করিয়ে দিয়েছেন বলেই ধ্বজা পতিত হয়েছে।" রাজা তখন বললেন যে বটুকরা দেবাদিদেব মহাদেব ও দেবী পার্বতীর সন্তান রূপে স্বীকৃত। এই ভাবেই দেবাদিদেব মহাদেব তাদের মহিমা বর্ধন করে গিয়েছেন।