সুদূর জার্মানি। সময়টা ১৯২১।
এক বিজ্ঞানীর রাতে ঘুম নেই। ওট্টো লুই নামে ওই বিজ্ঞানীটি বেশ কয়েক দিন ধরেই একটি পরীক্ষা করছিলেন।
তাঁর পরীক্ষারগারের প্রাণীটি যদিও ছিল একটি ব্যাঙ, কিন্তু লুইয়ের মনে প্রশ্নগুলো তৈরি হয়েছিল মানুষের বিভিন্ন অভিব্যক্তি দেখে।
মানুষের নানান আবেগ, অনুভূতি প্রকাশের মাত্রার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা থাকে স্নায়ুর। দুঃখ হলে কান্না, আনন্দে হাসি এসব কিছুই স্নায়ুকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। কিন্তু স্নায়ু তো শরীরের একটি অংশ, আসল অনুভবের কাজটা তো করে আমাদের মস্তিষ্ক এবং মন, তাহলে যে অনুভব মস্তিষ্ক এবং মনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, স্নায়ুকে তা কিভাবে প্রভাবিত করছে?
এই প্রশ্নই ওই বিজ্ঞানীকে কিছুতেই স্বস্তি দিচ্ছিল না। কিন্তু পরীক্ষাগারে মানুষকে এনে তার শরীর নিয়ে কাটাছেঁড়া করার সুযোগ নেই, তাই তিনি বেছে নিয়েছিলেন ব্যাঙকে। এদিকে ব্যাঙের তো আর মানুষের মত অনুভূতি নেই, তাহলে উপায়?
ওট্টো লুই তখন ব্যাঙের হৃৎপিন্ডে রক্ত পৌঁছলে তার স্নায়ুর পরিবর্তন কী কী পরিবর্তন হচ্ছে, সেদিকে নজর রাখতে শুরু করলেন। ভাবলেন এভাবেই খুঁজে পাবেন তাঁর ভাবনার উত্তর।
ব্যাঙের হৃদযন্ত্রকে বৈদ্যুতিক তরঙ্গের মাধ্যমে উত্তেজিত করলেন তিনি। বৈদ্যুতিক সংযোগের মাধ্যমে একটি ব্যাঙের হৃদপিন্ডের সঙ্গে অন্য একটি ব্যাঙের হৃদপিণ্ডকে সংযুক্ত করলেন।
দেখা গেল, তাদের স্নায়ুতে একটি বিশেষ রাসায়নিক পদার্থ তৈরি হচ্ছে, আর দুটি ব্যাঙের হৃদপিন্ডের মধ্যেই যোগাযোগ স্থাপন হচ্ছে। এই যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে স্নায়ুতে তৈরি হওয়া ওই বিশেষ রাসায়নিক পদার্থটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
যদিও ওই রাসায়নিক পদার্থটি আগেই হেনরি ডাল নামে একজন বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু পদার্থটির এরকম কার্যকারিতা আবিষ্কার করলেন ওট্টো লুই। পদার্থটি ছিল অ্যাসিটাইলকোলিন নামের একটি রাসায়নিক।
লুই এই ধরনের রাসায়নিকের নাম দিলেন নিউরোট্রান্সমিটার বা রাসায়নিক দূত যা স্নায়ু আর আমাদের শরীরের কোষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সকল আবেগ। নিউরোট্রান্সমিটারের জনক হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন শারীরবিদ্যা বিভাগে প্রথমবার নোবেল পুরস্কার।
আমাদের সকল অনুভূতি, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে এই নিউরোট্রান্সমিটার। স্নায়ুর বিশেষ অংশ নিউরনে উপস্থিত থাকে এই রাসয়নিক।
কোন ঘটনা বা দৃশ্য অথবা আপনজনের থেকে পাওয়া আঘাত বা আনন্দ সবই প্রথমে আমাদের স্নায়ুকে উত্তেজিত করে। স্নায়ুতে অবস্থিত নিউরোট্রান্সমিটারের ক্ষরণ শুরু হয় তখন , সেই নিউরোট্রান্সমিটারই এটা বলে দেয় আমরা হাসব, না কাঁদবো নাকি নিরুত্তাপ থাকব।
অ্যাসিটাইলকোলিন, ডোপামাইন, সেরোটোনিন, এপিনেফ্রিন ইত্যাদি নানা ধরনের নিউরোট্রান্সমিটার জীবিত প্রাণীদের দেহে উপস্থিত থাকে। মানুষ ছাড়াও অন্যান্যপ্রাণীদের দেহেও উপস্থিত থাকে এটি এবং তাদের যেকোনো কার্যকারিতাকে নিয়ন্ত্রণ করে।
মনোবিদরা বলেন, যেকোনও ধরনের মানসিক সমস্যার কেন্দ্রেও থাকে নিউরোট্রান্সমিটারের কার্যকারিতা। আমাদের আশেপাশের কোন ঘটনা যা আমাদের মনকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে, তা বাড়িয়ে দেয় এমন কিছু নিউরোট্রান্সমিটারের ক্ষরণ যার ফলে সৃষ্টি হয় অবসাদ। কিন্তু যা করলে মন ভাল থাকে, তৃপ্তি মেলে অন্তরে, স্বভাবতই তা বাড়িয়ে দেয় ভালো নিউরোট্রান্সমিটারের ক্ষরণ।
তবে নিউরোট্রান্সমিটারের ক্ষরণের জন্য অনেকাংশেই দায়ী আমাদের হরমোন। তাই হরমোনের সঠিক কার্যকারিতার জন্য প্রতিদিন শরীরচর্চা, মানসিক চর্চা খুবই জরুরী। এমন কিছু বিষয় যার সঙ্গে ভালোলাগা জড়িয়ে থাকে, প্রতিদিনের রুটিনে তেমন কিছু রাখলে তা বাড়িয়ে দেয় সেই হরমোনের ক্ষরণ যা আমাদের ভালো নিউরোট্রান্সমিটারগুলোকে সংযোগ স্থাপনে সাহায্য করে। যেমন ডোপামাইন।
ডোপামাইন নামে নিউরোট্রান্সমিটারের ক্ষরণ আমাদের মনে কোন হতাশা বা অবসাদ জমতে দেয়না। অর্থাৎ নিউরোট্রান্সমিটারই স্নায়ুকে এক প্রকার নিয়ন্ত্রণ করে আদেশ দেয় ভালো বা মন্দ থাকার। তাই বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলে ‘রাসায়নিক দূত ।
ওট্টো লুইয়ের সেদিনের আবিষ্কার আমাদের মনের সমস্ত আবেগ-অনুভূতির গোপন তথ্যকে সুস্পষ্ট করেছিল, বর্তমান যুগে মানসিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে যা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।