পরাধীন ভারতে বিপ্লবীরা ছিলেন শাক্ত। তাঁরা দেবী কালিকার পুজো করতেন। মা কালীর সামনে শপথ নিতেন দেশকে স্বাধীন করার। ভারত মায়ের শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী সন্তান নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুও ছিলেন মা কালীর উপাসক। তাঁর আধ্যাত্মিক জীবন পুরোদস্তুর কালী প্রভাবিত। কালীর উপাসক রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের শিষ্য বিবেকানন্দের লেখা পড়ে ভারতকে চেনার, ভালবাসার কথা বলে গিয়েছেন সুভাষচন্দ্র। বিবেকানন্দের দর্শন সুভাষচন্দ্রকে প্রভাবিত করেছে। সে দর্শন তাঁকে কালীভক্ত করে তুলেছিল।
আজীবন মা কালীর চরণ বুকে ধরে রেখেছিলেন সুভাষচন্দ্র। তিনি তন্ত্রসাধনা করতেন। শক্তি আরাধনায়ও মগ্ন থেকেছেন। মাতৃ আরাধনা করেছেন। কৈশোরে সুভাষচন্দ্র গঙ্গাজলে দাঁড়িয়ে কালীর প্রতি আবৃত্তি করেছেন। তিনি নিয়মিত দক্ষিণেশ্বরে যেতেন। তাঁর দক্ষিণেশ্বরে যাওয়ার কথা বিপ্লবী সত্যরঞ্জন বক্সিও নিজের লেখায় উল্লেখ করেছেন। সত্যরঞ্জন লেখা থেকে জানা যায়, সুভাষচন্দ্র কখনও কখনও উমাকে সঙ্গে নিয়ে দক্ষিণেশ্বরে যেতেন। মা ভবতারিণীকে দর্শন করে তিনি মোহিত হতেন। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের সঙ্গে তাঁর অন্তরের যোগ ছিল। তাঁর আদর্শ শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের সাধনক্ষেত্র হল দক্ষিণেশ্বর। ত্রিপুরী কংগ্রেসে সভাপতি পদে জয়ের পর যখন তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল, তখন তিনি দক্ষিণেশ্বরের মায়ের পুজোর ফুল নিয়ে কংগ্রেস ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর অনুগত স্বাধীনতা সংগ্রামীরা মায়ের আশীর্বাদস্বরূপ ফুল, প্রসাদ তাঁকে পাঠাতেন। দেশ ছাড়ার আগেও তিনি মা ভবতারিণীর চরণের ফুল নিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৪১ সালে জানুয়ারিতে মহানিষ্ক্রমণের কয়েকদিন আগে দুই ভাইজি ইলা ও বেলাকে গভীর রাতে দক্ষিণেশ্বরের মায়ের পায়ের ফুল ও চরণামৃত আনতে পাঠিয়েছিলেন মন্দিরে। তিনি সংকল্প নিয়েছিলেন মা ভবতারিণীর আশীর্বাদ না নিয়ে তিনি দেশত্যাগ করবেন না। এই ঘটনার এক-দুদিন পরই মহানিষ্ক্রমণ ঘটে।
কালীঘাটেও যেতেন দেশনায়ক। নেতাজির জীবনে একাধিক সাধক এসেছেন, নেতাজির সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাৎ হয়েছে। সখ্য গড়ে উঠেছে। সুভাষচন্দ্র তন্ত্রাচার্য বরদাচরণ মজুমদারের কাছে গিয়েছিলেন। বরদাচরণ তাঁকে ঘরে নিয়ে গিয়ে শক্তিসাধনার পথের নির্দেশ ও পরামর্শ দেন। তারাক্ষ্যাপার সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের সাক্ষাৎ হয়েছিল বলেও শোনা যায়। শুভকাজের জন্য তিনি বেছে নিতেন কালী পুজোর দিনগুলোকে। ১৯৪৩ সালের অক্টোবর মাসের ২১ ও ২৩ তারিখ তিনি যখন আজাদ হিন্দ সরকারের প্রতিষ্ঠা করছেন ও আমেরিকা এবং ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছেন, দিন দুটি ছিল কালীপূজা ও দীপাবলি। জেলে অনশন শুরু করার জন্যও কালীপুজোর দিনকেই বেছে নিয়েছিলেন নেতাজি। ১৯৪০ সালে প্রেসিডেন্সি জেলে ৯ নভেম্বর কালীপুজোর দিন সকাল থেকে অনশন শুরু করেছিলেন সুভাষচন্দ্র। তাঁর চিঠিতে কালীর নাম থাকত। শ্যামা সঙ্গীত গাইতেন। নৌকায় বসে শ্যামা সঙ্গীত গাইতে গাইতে বেলুড় মঠ যেতেন দেশনায়ক।
সিঙ্গাপুর রামকৃষ্ণ মিশনের মন্দিরে গিয়ে তিনি ধ্যানে করতেন। নেতাজি মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী ভাস্বরানন্দের কাছে, মা কালীর পায়ের কাছে বসে থাকা রামকৃষ্ণের ছবি চেয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্র বলেছেন, তাঁর জীবনে একমাত্র মা কালীর ইচ্ছাই ফলবতী। তাঁর এলগিন রোডের বাড়িতে শয়নকক্ষে মা কালীর ছবি থাকত। নেতাজি যেখানেই যেতেন তাঁর সঙ্গে থাকত জপের মালা, গীতা ও মা কালীর পায়ের জবা ফুল। মা কালীই ছিলেন নেতাজির ভরসা, যাবতীয় শক্তির উৎস।