একটি সিনেমা-Hall এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু

ইংরেজি 'ফার্স্ট বুক' রচয়িতা ইতিহাস-বিখ্যাত প্যারীচরণ সরকারের নাতির ছেলে বীরেন্দ্রনাথ সরকার। নাতিও ইতিহাস-বিখ্যাত হবেন বি এন সরকার নামে। সিনেমার ইতিহাসে। কর্পোরেশনের কন্ট্রাক্টর হয়েও একদা তিনি স্বপ্ন দেখলেন স্বাধীন সিনেমা স্টুডিও স্থাপনের এবং ছায়াছবি প্রযোজনার। স্বপ্ন সার্থক হল।

চণ্ডী ঘোষ রোডে দশ বিঘা জমির ওপর গড়ে তুললেন 'নিউ থিয়েটার্স' স্টুডিও। অবশ্য এই স্টুডিও তৈরি এবং স্টুডিওর ব্যানারে ছবি নির্মাণের আগে সরকারমশাই প্রমোদনাথ রায় ও অমরদাস মল্লিক নামে দুই বন্ধুর সঙ্গে 'ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ক্র্যাফট' নাম দিয়ে একটি প্রযোজনাসংস্থা গড়ে তুলেছিলেন। প্রথমে তারই অধীনে শুরু হয়েছিল ছায়াছবি নির্মাণের হররা। 

তখন সিনেমা-ব্যবসায় ম্যাডান কোম্পানির একচেটিয়া রাজত্ব। শহর ও শহরতলির প্রায় সমস্ত 'সিনেমা হল্'-ই তাঁদের। বছরভর তাঁরা নিজেরাই এত ছবি তৈরি করেন যে, অন্যরা তাঁদের 'হল্'-এ ছবি রিলিজের সুযোগই প্রায় পান না। এবং, তাঁরা সুযোগ দিতেও চান না। ফলে, বীরেন্দ্রনাথ বুঝলেন ছবি তৈরির আগে তাঁকে নিজেদের জন্য একটি সিনেমা 'হল্' তৈরি করে নিতে হবে। কাজেই তৈরি হল, 'চিত্রা'। সময়টা সাল হিসেবে, ১৯৩০। ভবানীপুরের 'পূর্ণ' এবং শ্যামবাজারের 'শো হাউস'-কে ধরে 'চিত্রা' হল বাঙালির তৈরি বাঙালি মালিকানায় তিন নম্বর সিনেমা 'হল্'।

'চিত্রা' তৈরি তো হল। কিন্তু, উদ্বোধন করবেন কে? সরকারমশাই অবশ্য ভেবে রেখেছেন যে, এই 'হল্' উদ্বোধন করবেন একজনই, তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। নেতাজি তখন অসম্ভব জনপ্রিয় যুবনেতা। তিনি যেখানে যান, সেখানেই উপচে পড়ে সাধারণ মানুষের ভিড়। মানুষ হিসেবে, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে সুভাষচন্দ্র সরকারমশাইয়ের অসম্ভব প্রিয়। কিন্তু, মুশকিল হচ্ছে, তাঁকে রাজি করানো।

যাই হোক, সুভাষচন্দ্রের কাছে একদিন সরকারমশাই গেলেন তাঁর আবদার নিয়ে। বাঙালির উদ্যোগে সিনেমা 'হল্' তৈরি হয়েছে শুনে নেতাজি খুব খুশি হলেন। তিনি যাবেন। অবশ্যই যাবেন এবং উদ্বোধন করবেন; তবে, একটাই শর্তে। নেতাজি রাজি হয়েছেন, এতেই সরকারমশাই আহ্লাদে আটখানা! তিনি সেই আহ্লাদে কোনকিছু না-ভেবেই বলে বসলেন যে, শর্ত যাই হোক না কেন, মানতে তাঁর কোন আপত্তি নেই!

নেতাজি তখন বললেন যে, তিনি যাবেন বটে, তবে এই অনুষ্ঠানে এবং তার আশপাশে কোন পুলিশ যেন না-থাকে। ততদিনে বেশ কয়েকবার নেতাজির জেলে যাওয়া হয়ে গেছে এবং ইংরেজের সঙ্গে সঙ্গে তাদের  পুলিশগুলোও তাঁর চোখে বিষ হয়ে গেছে। ইংরেজের পুলিশ তাঁর সুরক্ষার ভার নেবে, এটা তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারবেন না। 

সরকারমশাই শর্তে রাজি হলেন বটে, কিন্তু পড়লেন মহা আতান্তরে। নেতাজিকে দেখতে উপচে পড়বে কয়েক হাজার লোকের ভিড়। সেই ভিড় পুলিশ না-ডেকে তিনি সামলাবেন কেমন করে! কিন্তু, কথা যখন দিয়েছেন, উপায় তো একটা ভাবতেই হবে। ভাবলেন এবং পেয়েও গেলেন একটা উপায়। 

সেই সময় রেসকোর্স অঞ্চলে 'আলীভাই' বলে একটা লোক ছিল, পুরো নাম, জব্বর আলী। রেসকোর্স-এর পুরো ভিড়টা সে একাই সামলাত তার চ্যালাদের নিয়ে। সরকারমশাই গিয়ে ধরলেন তাকে, ভাই, এবারের মতো আমায় উদ্ধার করে দাও! নেতাজির আসছেন শুনে জব্বর তো এক কথায় রাজি। তখন সরকারমশাই হাতে চাঁদ পেয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

নির্দিষ্ট দিনে নেতাজি এলেন। স্বভাবতই তাঁকে দেখতে ভিড় উপচে পড়ল। কিন্তু, জব্বরের ব্যবস্থাপনায় কোন হাঙ্গামা হল না। নেতাজি 'চিত্রা'-র দ্বার-উদঘাটন করলেন। সরকারমশাইকে উপদেশ দিলেন--বিদেশি ভাষাকে প্রাধান্য দিও না, বাঙালির জন্য বাংলা ভাষায় ভালো ভালো ছায়াছবি তৈরি করো!

বি এন সরকার তাঁর প্রিয় নেতাজির উপদেশ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। বাঙালির জন্য অসাধারণ সব বাংলা ছবি প্রযোজনা করেছেন তিনি ও তাঁর 'নিউ থিয়েটার্স'। শুধু তাই নয়, বাংলায় টিকিট ছাপানোর প্রথা 'চিত্রা' সিনেমা হলের কাউন্টার থেকেই প্রথম শুরু হল। শুরু করলেন বি এন সরকার। সেও নেতাজির নির্দেশে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...