কাঠমান্ডুর পশুপতি নাথ মন্দির। অন্য অনেক পুজো দিতে আসা মানুষের ভিড়ে দেখা যেত এক মহিলাকে। বেশভুষা, চেহারায় আপাত সাধারণ, তবু চোখ টেনে নিতেন তিনি। আর পাঁচজনের ভিড়ে একটু অন্যরকম। বাকিরা খুচরো পয়সা ছুঁড়ে দিয়ে চলে গেলেও এই মহিলা দাঁড়িয়ে থাকতেন। কথা বলতেন মহিলা ভিক্ষাজীবীদের সঙ্গে। ছোট-ছোট কথায় উঠে আসত তাদের জীবন।
তারা বেশিরভাগই লিঙ্গ বৈষম্যের জেরে নিগৃহীত হয়ে ঘরের বদলে রাস্তায়। পেটের তাগিদে আর কোনও পথ না পেয়ে বেছে নিয়েছে ভিক্ষার পাত্র।
তাদের কথা ভীষণ ভাবে নাড়া দিয়েছিল তাঁকে। নিজস্ব অতীত যেন মিলে মিশে যেত।
পশুপতি মন্দিরের চত্বরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এইগল্পগুলোই একদিন বদলে দিল তাঁর জীবন।
স্কুল শিক্ষিকার চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি পথে নামলেন একদিন। শুরু হল অন্য এক পথ চলা। কয়েক শতক পর নেপাল উপত্যকা তাঁকে চিনল ‘মা টেরেসা’ নামে। প্রকৃত নাম অনুরাধা কৈরালা। নেপালী মানুষের কাছে তিনিই ‘মাদার টেরেসা’।
তিনি নিজেও ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। প্রত্যেকদিন স্বামীর হাতে নিগৃহীত হতে হত। তার মাত্রা এতটাই যে তিন-তিনবার গর্ভপাত ঘটে। তারপরই বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলো ফিকে হয়ে যায়নি মন থেকে।
পথে কুড়িয়ে পাওয়া যন্ত্রণার গল্পগুলো তাঁকে অন্যরকম ভাবে ভাবতে বাধ্য করল।
ক্লাসরুম, সিলেবাসের বাইরে আরও বড় কোনও জীবন। যেখানে এই অসহায়তার গল্পগুলো শুনে চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকার বদলে কিছু অন্তত করা যাবে।
অসহায় যন্ত্রণায় গুমরে মরা, বা হারিয়ে যাওয়া যে জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি নয় তা মানুষকে জানান দেওয়া জরুরি।
পেশায় শিক্ষিকা অনুরাধা স্থানীয় একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। মন্দির চত্বরের ভিক্ষাজীবী মহিলাদের বোঝাতে শুরু করলেন ভিক্ষার পথ চেড়ে দেওয়ার জন্য। কাজটা সহজ ছিল না। বেশিরভাগই রাজি হল না। তবু তাদের মধ্যে থেকেই ৮ জন তাঁর কথা মানতে রাজি হল।
নিজের সামান্য সঞ্চয় থেকেই তাদের প্রত্যেককে তিনি ১০০০ টাকা করে দিলেন। যা মূলধন করে তারা রাস্তায় ছোটখাটো দোকান বা ব্যবসা শুরু করতে পারে। তারা প্রতিদিন যা আয় করত, তা থেকে দু' টাকা করে সংগ্রহ করতেন অনুরাধা। সংগৃহীত অর্থ দিয়ে তাদেরই মতো বাকি অসহায়দের সাহায্য করা হত।
তাঁর লক্ষ্য ছিল তাদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে দেওয়া।ভিক্ষাবৃত্তির জীবন থেকে সরিয়ে সমাজের মূল স্রোতে পুনর্বাসন।
সালটা ১৯৯৩। একটা সময়ের পর অনুরাধার প্রচেষ্টার কথা মানুষ জানতে পারল। এগিয়ে এল আরও হাত। আরও মানুষ।
একটি সংস্থা তৈরি করলেন। নাম দিলেন ‘মাইতি নেপাল’।‘মাইতি’ একটি নেপালি শব্দ, বাংলায় যার মানে দাঁড়ায় ‘মায়ের বাড়ি’।
নারী নির্যাতন, পুনর্বাসনের সঙ্গে সঙ্গে নারী পাচারের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে পুরোপুরি কাজ শুরু করলেন অনুরাধা কৈরালা।
আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া, দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের টার্গেট করা হত। পরিবারকে মোটা টাকার লোভ বা রাতারাতি আর্থিক সংকট বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখানো হত।
সেই ফাঁদে পা দিয়ে ফেলত অনেকেই। ফলাফল হত ভয়ঙ্কর।
অশিক্ষা আর চরম দারিদ্র এই সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। মূল সমস্যা ছিল গ্রামগুলোতে৷
১৯২৬ সাল থেকে নারী পাচারের সমস্যা মাথাচাড়া দিলেও তা বিষয়টি নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মতো স্বর সেভাবে শোনা যায়নি।
১৭৫০ কিমি ভারত নেপাল সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়ে যেত মেয়েরা। সেখান থেকে ভারত,চীন এবং পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে। ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত প্রায় ২৩ হাজারের বেশি মেয়ে এভাবেই হারিয়ে গিয়েছিল।
পরের বছর গুলোতে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪০ হাজার।
ইউনিসেফ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর প্রায় ১২ হাজার শিশু নেপাল-ভারত সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়ে যায়। বেশিরভাগের জায়গা হয় পতিতালয়। অঙ্গ-প্রতঙ্গ অপসারণ করে সস্তার শিশু শ্রমিক হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
অনুরাধা কৈরালা তাঁর সংস্থার সহায়তায় নারী ও শিশু পাচার বন্ধ করার তাগিদে নেপালের সীমান্তে কয়েকটি উদ্ধার কেন্দ্র স্থাপন করেন। এরকম ২৬টি কেন্দ্র ভারত এবং নেপালের সীমান্তে গড়ে উঠেছে।
১৮ হাজার মেয়েকে বাঁচিয়েছে। তাদের মধ্যে পাচার হয়ে যেতে বসা মেয়ে যেমন ছিল তেমনি যৌনপল্লী থেকে উদ্ধার করে আনা মেয়েরাও আছে। তাদের পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছে। অনেকে ছাদ হারাবার ভয়ে হাজার এক অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করে যেতে বাধ্য হন। তাদের জন্য আশ্রয় অনুরাধা কৈরালা।
নিজের কাজের জন্য তিনি নেপালের 'মাদার টেরেসা' ।
সত্তর বছরের অনুরাধা তাঁর অসামান্য কাজের স্বীকৃতি হিসেবে দেশে-বিদেশে অজস্র সম্মান পেয়েছেন। ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে সম্মানীত করেছে। ২০১০ সালে ২০১০ সালে পান ‘সিএনএন হিরো অব দ্য ইয়ার'।
অনুরাধার মেয়েদের অধিকার রক্ষায় সংগ্রামের জন্য নেপাল সরকার ৫ সেপ্টেম্বর তারিখটি 'পাচারবিরোধী দিবস' হিসেবে ঘোষণা করেছে।
অনুরাধা বলেন, “ একবার নিজের মেয়েকে ওই অসহায় মেয়েদের জায়গায় রেখে দেখুন। কী করতেন আপনি? কীভাবে লড়াই করতেন? সেই জন্যই এই লড়াইতে আপনার হাতটা জরুরি। প্রত্যেকটি শিশু আসলে আপনারই মেয়ে। তখন অনুভব করতে পারবেন ওদের যন্ত্রণাটা। লড়াইয়ের জোর আপনি আসবে”।