‘আমাকে বিচার করো আমার ব্যর্থতা আর ব্যর্থতার পর ঘুরে দেখানো দেখে’

“আমার সাফল্য দিয়ে আমায় বিচার করো না। আমাকে বিচার করো আমার ব্যর্থতা আর ব্যর্থতার পর ঘুরে দেখানো দেখে।”

ব্যর্থতা আর ঘুরে দাঁড়ানো এই নিয়েই তাঁর জীবন। অন্ধকার যতই কালো হোক আলোর পথে ঘুরে দাঁড়ানোতেই সে সফল হয়ে ওঠে। মানুষের প্রতি এই ছিল তাঁর বার্তা। পুরো নাম নেলসন রোলিহলালা ম্যান্ডেলা। আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপ্রধান।

পৃথিবীর দক্ষিণে আটলান্টিক মহাসাগর ও ভারত মহাসাগর যেখানে মিলিত হয়েছে, তার ঠিক পশ্চিমে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন শহর। কেপটাউনের সমুদ্র উপকূল থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে গভীর সমুদ্রে ছয় বর্গ কিলোমিটার আয়তনের রোবেন দ্বীপের অবস্থান।

প্রথম দিকে এই দ্বীপে কৃষিকাজ হলেও পরে এই দ্বীপ হয়ে ওঠে ক্রীতদাসদের শাস্তিভূমি। ঔপনিবেশিক আমল থেকে এই দ্বীপে ব্রিটিশরা অপরাধীদের বন্দী করে রাখত।

রোবেন আইল্যান্ডে একটা ছোট্ট ঘুপচি ঘর। মাটিতে বিছানা। অনেক ওপরে জানলা। সূর্য দেখা যায় না। এমন এক ঘরেই কেটেছিল তাঁর জীবনের ১৮ বছর। ১৮ বছর তিনি সূর্য দেখেননি। আরও ৯ বছর অন্য কারাগৃহে। দীর্ঘ ২৭ বছরের বন্দী জীবন। তাঁর নিজের ভাষায় ২৭ বছরের লম্বা ছুটি।  

ভোর পাঁচটা বাজলেই ঘুম ভেঙে যেত সাইরেনে। একটা ছোট্ট লোহার বালতিতে মিলত জল। ওই জলেই স্নান-ক্রিয়া। পরনে খাকি রঙের আধা-পাজামা।  

কারাগারের খোলা উঠোনে বড় পাত্রে থাকত গুঁড়ো করা ভুট্টা। অনেক সময় দেখা যেত তা পচা, খাওয়ার অযোগ্য। আর ভুট্টার পানীয়।  দুপুরের আহার ভুট্টাসেদ্ধ। রাতেও তাই।

পায়ে জুতোর ব্যবস্থা ছিল না। শীতের দিনে খালি পায়ে বরফ ঠাণ্ডা উঠোনের ওপর দিয়ে হাঁটতে পায়ের পাতা জমে যেত, কিন্তু চলতে হত এভাবেই। প্রতিদিন লাইন দিয়ে বসে চলত কয়লা ভাঙার কাজ। চুনা পাথরের খনিতে কাজ করতে হত।

চারটে বাজলে মিলত রেহাই। সমুদ্রের জলে গা ভিজিয়ে নিজের কুটুরিতে। তারপর আবার সেই একই জীবন। মাঝেই মাঝেই উপরি পাওনা কারারক্ষীদের অত্যাচার।

বছরে একবার ৩০ মিনিটের জন্য একজন পরিচিতের সঙ্গে দেখা। ৬ মাস অন্তর মিলত বাড়িতে চিঠি পাঠাবার অনুমতি।

নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন গ্রুপ ডি বন্দী। গ্রুপ ডি বিভাগের বন্দিরা সবচেয়ে কম সুযোগসুবিধা পেত। এমনকি তাঁর চিঠিও সেন্সর করা হত। অনেক সময় হাতে পেতেন না। অনেক সময় চিঠি হাতে আসার পর দেখতেন কালি দিয়ে পাঠের অযোগ্য করে দেওয়া।

কিন্তু এই রবিন আইল্যন্ডের জীবনই আমূল বদলে দিয়েছিল নেলসন ম্যান্ডেলাকে। তাঁর বুদ্ধি, ব্যক্তিত্ব আর সহমর্মী আচরণ বদল এনেছিল কারারক্ষীদের মধ্যেও। তিনি মনে করতেন ক্ষমা দিয়ে অনেক তাড়াতাড়ি বদল আনা যায় মানুষের মধ্যে।

দীর্ঘ ২৭ বছর বন্দী থাকার পর ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি মুক্তি পান। ২৪ ঘন্টারও কম সময়ের মধ্যে তাঁকে ছাড়া হয়। নেলসন নিজেও খুব কম প্রস্তুতির সময় পেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর মুক্তির পর গেটের বাইরে এসে নিজের সঙ্গীদের সঙ্গেই ফিরে যাবেন।

সরকার চেয়েছিল খুব নীরবে নেলসনকে মুক্তি দিতে। কিন্তু তা হওয়ার নয়, তিনি ফিরেছিলেন রাজার মতো। মানুষের হৃদয়ের ‘মাদিবা’ হয়ে।   

তিনি বলেছিলেন ‘জীবনে যদি কিছু করতে চাও, তাহলে একলা কীভাবে লড়তে হয় তা শিখে নাও...’

মাদিবা নিজেও যেন তেমনই। কারাগারের অন্ধকার ভেদ করে নিজেই প্রমিথিউস হয়ে আলো এনেছিলেন নিজের জীবনে। সেই আলো ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা পৃথিবীতে। আজও একা মানুষের লড়াই জোর খুঁজে পায় এই নামের কাছেই।

  

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...