১৩০ কোটি ভারতবাসীর স্বপ্নপূরণ করেছেন হরিয়ানার সোনেপতের ২৩ বছরের যুবক। অলিম্পিক অ্যাথলেটিকসে ভারতকে প্রথম সোনা এনে দেওয়া নীরজ কুমারের লড়াইও কিন্ত সহজ ছিল না। একটা সময় তাঁকেও কটাক্ষ শুনতে হয়েছে 'মোটা বাচ্চা' বলে।
বস্তুত গোটা শৈশব তাঁকে নিজের স্থূলকায়ত্বের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। লড়াই করতে হয়েছে নিজের সঙ্গে। আর সেই লড়াইয়ে তিনি আজ জয়ী।পানিপতের পার্শ্ববর্তী খাণ্ডারা গ্রামে জন্ম নীরজের। বাবা কৃষক। দিন আনা দিন খাওয়া পরিস্থিতি না হলেও নীরজ সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মাননি।
ছোটবেলায় তাঁর বাবা-মাও তাঁকে অ্যাথলিট তৈরির স্বপ্ন দেখতেন না। আর পাঁচটা মধ্যবিত্তর মতো তাঁরাও ছোট ছোট স্বপ্ন দেখতেন। নীরজের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল তাঁর ওজন। বয়স যখন ১১ বছর, তখন ওজন ছিল ৯০ কেজি। রীতিমতো 'মোটা বাচ্চা' ছিল নীরজ। সেজন্য বন্ধুমহলে টুকটাক খোঁচাও শুনতে হত হয়তো। আমাদের সমাজে 'মোটা বাচ্চা'দের বডি শেমিং তো খুব সাধারণ ব্যাপার। নীরজের কাকা তাঁকে প্রথমে পানিপতে সাইয়ের একটি জিমে ভরতি করিয়ে দেন। উদ্দেশ্য ছিল, ছেলের শরীরের ওজন কমানো। যাতে স্থূলকায়ত্বের যন্ত্রণা তাঁকে সহ্য করতে না হয়। সালটা ২০১১। সেটাই হয়ে যায় নীরজের জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।
সাইয়ের স্টেডিয়ামেই প্রথম জ্যাভলিন ছোঁড়া শুরু করেছিল বছর তেরোর কিশোর। নীরজের কাকা ভীম চোপড়া বলছিলেন, 'আমরা তো জানতামই না ও কবে বর্শা ছোঁড়া শুরু করেছে।'সাই সেন্টারে ভরতি হওয়ার পর কয়েক বছরের মধ্যে পালটে যায় নীরজের জীবন। ২০১৬ সালে প্রথম লাইমলাইটে আসেন ভারতের সোনার ছেলে। সেসময় বিশ্ব অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়ন হন তিনি। কিন্তু অল্পের জন্য অলিম্পিকে যোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি।
সেই আক্ষেপ হয়তো পুষে রেখেছিলেন নিজের মনে। ২০১৮ সালে কমনওয়েলথে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর থেকেই নীরজ বিশ্বের সেরাদের মধ্যে পরিগণিত হন। টোকিও অলিম্পিকে নিজের সেরাটাই দেন তিনি। স্বপ্নপূরণ করেছেন গোটা দেশের।
২০২১ সাল ভারতের মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে ওই স্থূলকায় ছেলেটার জন্যই। প্রথম ভারতীয় হিসাবে অ্যাথলেটিক্সে সোনা জয়। সে কি মুখের কথা। তিনি যা করে দেখিয়েছেন তা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। টোকিও অলিম্পিকের আগে, নীরজের থেকে তার উচ্চাশা ছিল এবং অনেকেই ব্রোঞ্জ, রুপো আশা করেছিল কিন্তু সোনা একটি স্বপ্নাতিত ছিল। ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার জায়গা করে দেন নীরজ নিজে।
নীরজ অত্যাশ্চর্য ৮৬.৬৫ মিটার থ্রো করেন, যা জ্যাভলিন থ্রো-এর ইতিহাসে অন্যতম সেরা ছিল। তার প্রথম প্রচেষ্টাতেই, তিনি ৮৩.৫০ মিটারের যোগ্যতা চিহ্নটি ভেঙে দিয়ে ফাইনালে ওঠেন। ফাইনালে, নীরজই প্রথম থ্রোটি করেছিলেন ৮৭.০৩ মিটার লম্বা। দ্বিতীয় থ্রোতে, তিনি ৮৭.৫৮ মিটার পেরিয়ে যায় তাঁর জ্যাভলিন এবং তিনি জিতে নেন সোনা।
স্বর্ণপদক জয়ী থ্রোয়ের ভিডিওটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল এবং ৭ আগস্ট সন্ধ্যায় সবার ঠোঁটে একটিই নাম ছিল, নীরজ। বিখ্যাত নীরজের সোশ্যাল মিডিয়ায় নীরজ চোপড়ার 'ফেস ভ্যালু' কত জানেন?
সম্প্রতি নীরজ চোপড়ার জনপ্রিয়তা নিয়ে একটা সমীক্ষা করে হয়েছে। সেই সমীক্ষার রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, টোকিও অলিম্পিক থেকে সোনা জেতার পর এই ভারতীয় অ্যাথলিটের জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
কিছুদিন আগে পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় ফলোয়ারের সংখ্যা সেভাবে দেখা যায়নি। অলিম্পিকে একটা সোনা জয়ই বদলে দিয়েছে ছবিটা। ভারতের প্রথম অ্যাথলিট হিসেবে অলিম্পিকে সোনা জিতে ইতিহাস তৈরি করেছেন। তারপর থেকেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে গেছেন নীরজ চোপড়া। সাম্প্রতিক সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন মাধ্যমে যতবার তাঁর নাম খোঁজা হয়েছে, তা বিশ্ব রেকর্ড। শুধু তাই নয়, নীরজ চোপড়ার সোশ্যাল মিডিয়ায় স্টক ভ্যালুর পরিমান জানলে চোখ কপালে উঠবে। ইতিমধ্যেই পৌঁছে গেছে ৪২৮ কোটি টাকায়।
সম্প্রতি নীরজ চোপড়ার জনপ্রিয়তা নিয়ে একটা সমীক্ষা করে হয়েছে। সেই সমীক্ষার রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, টোকিও অলিম্পিক থেকে সোনা জেতার পর এই ভারতীয় অ্যাথলিটের জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
৭ অগাস্টের পর থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ১৪ লক্ষ ব্যবহারকারী ২৯ লক্ষ বার নীরজের নাম কোথাও না কোথাও উল্লেখ করেছেন বলে সাম্প্রতিক রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে। যা বিশ্ব রেকর্ড। ওই রিপোর্টে আরও দাবি করা হয়েছে, ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রামে নীরজ চোপড়ার নামের উল্লেখের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৪০৫ ও ২০৫৫ শতাংশ হারে। এর ফলে সোশ্যাল মিডিয়ায় নীরজ চোপড়ার ব্যবহারকারীদের কাছে পৌঁছন এবং প্রভাব একলপ্তে বেড়ে ৪১.২ কোটি ছুঁয়ে ফেলেছে। ওই সমীক্ষার রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, নীরজ চোপড়ার সোশ্যাল মিডিয়া ভ্যালুয়েশন ৪২৮ কোটি টাকা।
নীরজের নিজের পোস্ট করা বা অন্যান্য নেটিজেনদের ভিডিওতে ৪০.৫ বার দেখা হয়েছে এই ভারতীয় সোনাজয়ী অ্যাথলিটকে। এমনই দাবি করা হয়েছে ওই রিপোর্টে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনুগামীর সংখ্যা একধাপে অনেকটাই বাড়িয়ে নিয়েছেন নীরজ চোপড়া। ইনস্টাগ্রামে তাঁর ফলোয়ার্স সংখ্যা প্রায় ৪৫ লক্ষ। অলিম্পিকে যাওয়ার আগের তুলনায় এক্ষেত্রে ২২৯৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া ইন্টারাকশান ৮৬.৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১.২৭৯ কোটিতে পৌঁছে গিয়েছে।
এবার তার লক্ষ্য ২০২২–এ বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপ, যা আমেরিকায় অনুষ্ঠিত হবে। পরের টার্গেট ২০২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিক। তার প্রস্তুতিও শুরু করে দিয়েছেন তিনি। আগামী তিন মাস কোচ ক্লস বার্তোনিয়েৎসের কাছে ট্রেনিং করবেন নীরজ। আর তার জন্য ক্যালিফোর্নিয়ার চুলা ভিস্তার বিশ্বমানের অ্যাকাডেমিতে পৌঁছেও গিয়েছেন তিনি। সেখানে ট্রেনিংয়ের একটি ছবি পোস্টও করেছেন সোনার ছেলে।
নীরজ ক্যালিফোর্নিয়ায় যাতে অফ সিজনের ট্রেনিং করতে পারেন, তার জন্য আবেদন করা মাত্র যাবতীয় ব্যবস্থা করে দিয়েছেন সাইয়ের কর্তারা। ৩৮ লক্ষ টাকা অনুমোদনও করা হয়েছে তাঁকে। টোকিও গেমসে ৮৭.৮৫ মিটার বর্ষা ছুঁড়ে সোনা পেয়েছিলেন। তার পর নিজেই বলেছেন, তাঁর লক্ষ্য ৯০ মিটার। সেই লক্ষ্যই এখন পূরণ করতে চান ভারতীয় অ্যাথলিট।
আপাতত নীরজ তাকাচ্ছে ২০২২ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের দিকে। তারপর কমনওয়েলথ গেমসে নামবেন। এশিয়ান গেমসে আরও একবার সোনা পাওয়ার লক্ষ্যে নামবেন তিনি। আসলে ধারাবাহিক ভাবে নিজেকে তৈরি করতে চান নীরজ। তারপর লক্ষ্য করবেন প্যারিস অলিম্পিককে।