ব্রতের একটি শাশ্বত মঙ্গলময় দিক আছে। সেই মঙ্গল গেরস্ত-সংসারের। সেই মঙ্গল গেরস্তের গণ্ডির মধ্যেই নিবদ্ধ যদিও, তবুও তার মধ্যে ত্যাগ আছে, কর্তব্য আছে, আত্মনির্যাতন আছে, ভালোবাসা আছে, আকাঙ্ক্ষা আছে, সর্বোপরি সবেতেই নিষ্ঠা আছে। আর এ-সবের মাঝখানে দেবাদিদেব মহাদেবও ধরা পড়েছেন ব্রতের ঠাকুরটি হয়ে। নাম পেয়েছেন, নীল ঠাকুর।
বাংলার ব্রতকথায় নীল শুধুই নীল নন, তাঁর সঙ্গে আছেন ষষ্ঠীও। দু'য়ে মিলে হলেন, 'নীল ষষ্ঠী'। কিন্তু, দু'জনে মিললেন কেমন করে? বলছি :
আসলে, ব্রতের দেব-দেবীরা বাড়ির মেয়েদের কাছে ঘরের লোক। ব্রতের গল্পে দেখতে পাই, দেব-দেবীরা পুজো প্রচারের জন্য কিংবা মঙ্গলের পথ দেখানোর জন্য কখনো স্বপ্নে, কখনো ছদ্মবেশে, কখনো স্ববেশে তাঁদের আকছার দেখা দেন। মজার কথা, বাড়ির কুমারী ও এয়োরা এঁদের সৃষ্টি করেন, এঁদের পুজো করেন, পুজোর প্রচার করেন, আবার এঁদের কৃপায় সুখে সংসারও করেন।
সেই নিছক নাড়িটেপা চিকিৎসার যুগে যখন হামেশাই বালিকা মায়েদের নবজাতকদের বাঁচানো যেত না, শিশুদের অনেকেই রোগে ভুগে অকালে মারা যেত, তখন গেরস্তের দ্বিতীয় আশা-ভরসার জায়গা ছিল কেবল দৈব। মায়েরা মানত করে, ব্রত করতেন তাদের বাঁচানোর জন্য, রোগ-বালাই প্রতিষেধের জন্য। তার জন্য তাঁদের কাছে প্রবাদ হয়ে উঠেছিলেন একমাত্র দেবী ষষ্ঠী। মাসে মাসে 'শীতল ষষ্ঠী', 'চাপড়া ষষ্ঠী', 'লোটন ষষ্ঠী', 'অশোক ষষ্ঠী' প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন নামে চলছিল তাঁর ব্রত ও পুজো।
একটা সময় এয়োরা চাইলেন ষষ্ঠীর এমন একটি রূপের পুজো করতে, যে ষষ্ঠী আর সকলের চেয়ে শক্তিধরী, যাঁর ব্রত-পুজো করলে সন্তানের জন্ম ও সুরক্ষা সবটাই বজায় থাকে। তার জন্য তাঁরা খুঁজে পেতে পেলেন শিব ঠাকুরকে। শিব লিঙ্গরূপে সুপ্রজননের প্রতীক, তিনি বন্ধ্যাকেও সন্তানবতী হতে আশীর্বাদ করবেন, এটা স্বাভাবিক। তাছাড়া, জগৎ বিধ্বংসী বিষকে কণ্ঠে ধারণ করে যিনি জগৎকে রক্ষা করেছেন, তিনি তো অনায়াসেই সমস্ত বালাই হরণ করে শিশুদের সুরক্ষিত রাখবেন। এসব ভেবেই এয়োরা নীলরূপী শিবকেই তাঁদের ব্রতের ঠাকুর করে ফেললেন।
এবার বলি, নীলের সঙ্গে 'ষষ্ঠী' কীভাবে এসে জুটলেন। লক্ষণীয় যে, ষষ্ঠী কিন্তু এখানে দেবী হয়ে নীলের সঙ্গী হলেন না। আসলে, 'ষষ্ঠী' বলতেই এয়োদের মনে ভেসে ওঠে সন্তান জন্মের আকাঙ্ক্ষা ও তাদের সুস্থ রাখার প্রত্যাশা। ফলে, 'ষষ্ঠী' তাঁদের এই ভাবনাটিরই প্রতীক। তাই নীলের ব্রত যে সন্তানের অভেদ্য মঙ্গলের জন্যই করা হচ্ছে, এই সত্যটি নির্দিষ্ট করার জন্য 'নীলের ব্রত'কে বলা হতে লাগল 'নীল ষষ্ঠী ব্রত'।
অন্যান্য ষষ্ঠী ব্রতের চেয়ে নীল ষষ্ঠী ব্রত যে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী, এটাও বলিয়ে দেওয়া হল ব্রত প্রচারের গল্পে স্বয়ং দেবী ষষ্ঠীর মুখ দিয়ে। আসুন, ছোট্ট করে সেই গল্পটি এবার শুনে নিই:
এক গাঁয়ে ছিল বামুন আর বামনি। দান-ধ্যান-পুণ্যে-ব্রতে তাদের কোনও খামতি ছিল না। তবু পাঁচ-পাঁচটি সন্তানের বাপ-মা হয়েও একটিকেও ধরে রাখতে পারল না তারা। বাপমাকে শোকে পাথর করে একে একে সব ক'টি চলে গেল। বামুন-বামনি কোন ষষ্ঠীর ব্রত-পুজো করতেই বাকি রাখলেন না, কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না।
যে ঘরে-দোরে ছেলেমেয়েরা খেলে বেড়াত, সেদিকে চাইলেই বুকের ভেতর হু হু করে, চোখ ফেটে জল আসে, ইচ্ছে করে না ভিটেয় এক দন্ড তিষ্ঠতে! কেবলই ইচ্ছে করে, সব ছেড়ে-ছুঁড়ে হয় পালিয়ে যেতে, নয় মরে যেতে।
একদিন আর পারলেন না। দু'জনে ভিটে ছেড়ে পাড়ি দিলেন নিরুদ্দেশের পথে। নিরুদ্দেশ কিন্তু উদ্দেশ্য খুঁজে নিল। তাঁদের নিয়ে গিয়ে তুলল কাশীতে। বামুন-বামনি ভাবলেন, এই বেশ হল, বাকি জীবনটা এখানে কাটিয়ে তবে এই শিবতীর্থেই মরব!
কাশীতে বিশ্বনাথের মন্দিরে পুজো দিলেন। মা অন্নপূর্ণার চরণে দণ্ডবৎ করলেন। তারপর গঙ্গায় ডুব দিয়ে ঘাটে এসে বসলেন। কিন্তু, এত কিছু করেও কই মন তো শান্ত হল না, সন্তান হারানোর শোক তো ভুলল না! সে ভিটেয় যেমন পোড়াচ্ছিল, বিভুঁইয়েও তো তেমনই পোড়াচ্ছে! হে ঈশ্বর, আমাদের জন্য তোমার পায়ের ধুলোকণার মতো শান্তিটুকুও কী তোলা নেই! দু'জনের চোখেই ঝরতে লাগল শোকের আবেগে ক্ষেদের বন্যা।
বামুন-বামনির কান্না শুনে এতদিনে যেন দেবী ষষ্ঠীর যেন দয়া হল। ঘাটের নরনারীকে বাট দেখাতে তিনি নেমে এলেন লাঠি হাতে এক বুড়ির বেশে। বললেন, 'হ্যাঁ গো, তোমরা কাঁদছ কেন?'
বামুন-বামনি গাঁয়ের সহজ-সরল মানুষ। ষষ্ঠী বুড়ি জিজ্ঞেস করতেই চোখের জল ফেলতে ফেলতে ধীরে ধীরে শোক-দুঃখ-মনের কথা একে একে বলে গেলেন।
সব শুনে ষষ্ঠী বুড়ি বললেন, 'আহা রে, অমন শোক-দুঃখ্যু শত্তুরেও যেন না-পায় কারো! তবে বাছারা এই কি তোমাদের তীর্থে পড়ে কাল কাটাবার বয়স! যাও, ঘরের মানুষ ঘরে ফিরে যাও। আর ভালো করে ষষ্ঠী ব্রত করো গিয়ে, তাতে সন্তান হবে, সুস্থ থাকবে, সংসার সুখের হবে। যাও বাছারা, ঘরে যাও!'
কথাগুলো শুনে বামনির বুকের ভেতর উথালিপাথালি হল। কান্না ভেজা কণ্ঠে বললেন, 'শেতল-অরণ্য-লোটন কোন ষষ্ঠীর ব্রতই বাদ দিইনি গো মা, তবুও তো বাছাদের ধরে রাখতে পারলাম না!' দীর্ঘশ্বাস আর চেপে রাখতে পারলেন না।
তাই শুনে ষষ্ঠী বামনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, 'নীল ষষ্ঠীর ব্রত কি করেছিলে মা? করনি না?'
বামনি অবাক হয়ে তাকালেন। 'নীল ষষ্ঠী ব্রত? নাম শুনিনি তো! সে ব্রত কবে, কেমন করে করতে হয়?'
তখন ষষ্ঠী বুড়ি বললেন, 'সমস্ত ষষ্ঠী ব্রতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্রত হচ্ছে মা এই নীল ষষ্ঠী ব্রত। এই ব্রত করলে তোমার আবার সন্তান হবে, তার বিপদ-বালাই দূরে থাকবে, নির্ভাবনায় ডাগর হবে। শোন মা, সমস্ত মাস সন্ন্যাস পালন করে চৈত্রের সংক্রান্তির আগের দিন ষষ্ঠী তিথিতে এই ব্রত উদযাপন করবে। সারাদিন উপোষ দিয়ে সন্ধ্যায় বাতি জ্বেলে শিবের পুজো করে উপোষভঙ্গ করবে, তাহলেই ব্রত সম্পূর্ণ হবে। বুঝেছ মা?'
বামনি মাথা নাড়তেই 'তোমাদের মঙ্গল হোক, মা!' বলে ষষ্ঠী বুড়ি লাঠি ঠুকতে ঠুকতে খানিক এগিয়ে ঘাটের ভিড়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
বুড়ির মুখে এই নতুন ব্রতটির কথা শুনে বামুন-বামনির মনে আবার আশা জাগল, সংসারে ফিরে আবার সব কিছু নতুন করে শুরু করার বাসনা জাগল।
বাড়ি ফিরে তাঁরা বুড়ির কথামতো নীল ষষ্ঠী ব্রত পালন করলেন। বছর ঘুরতেই তাঁদের আবার সন্তান হল। সেই সন্তান সুস্থভাবে বেঁচেবর্তে রইল। বংশ বাড়ল। তারপর একদিন নাতিপুতির মুখ দেখে বামুন-বামনি স্বর্গে গেলেন। তাঁদের সমৃদ্ধি দেখে ধীরে ধীরে 'নীল ষষ্ঠী ব্রত'র প্রসার বাড়ল, ঘরে ঘরে ব্রতের মাহাত্ম্য প্রচারিত হল।