কালী কথা: নায়েকালী মন্দির

উত্তরের পাহাড়ে যেমন রয়েছে মেটুলি কালী, সেবকেশ্বরী কালী তেমন বঙ্গোপসাগরের তীরে বিরাজ করেন নায়েকালী।

নায়েকালী অর্থাৎ নৌকার উপর মা কালীর অধিষ্ঠান। তবে নায়েকালী মন্দিরে সিংহের উপর মা দুর্গার মূর্তিও রয়েছে। ছোট নৌকার উপর মা কালীর ছোট পাথরের মূর্তি রয়েছে। এই মন্দিরে মা দুর্গা এবং মা কালী একসঙ্গে পূজিতা হন। দুর্গার ধ্যানমন্ত্রেই দেবীর পুজো হয়।

দীঘা লাগোয়া পূর্ব মুকুন্দপুর গ্রামে রয়েছে বিখ্যাত নায়েকালী মায়ের মন্দির। জানা যায়, মন্দিরের বয়স প্রায় তিনশো থেকে সাড়ে তিনশো বছর। বর্তমানে এই কালী মন্দির নতুনভাবে নির্মিণ করা হয়েছে। দীঘা মেরিন ড্রাইভের পাশে নায়েকালী মাকে দর্শন করার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন দর্শনার্থীরা। দেবী নায়েকালী কিন্তু, সাধারণ কালী নন। দেবীর মূর্তি সাধারণ কালীর মূর্তির মতোও নয়। দেবী নায়েকালী হলেন ব্যাঘ্রবাহিনী। তাঁর গলায় রয়েছে মুণ্ডমালা। দেবীর হাতে থাকে খড়্গ। দেখতে দেবী দুর্গার মতো, আদপে তিনি দেবী কালী ও দেবী দুর্গার মিশ্র রূপ। শোনা যায়, গাছের কোটর থেকে এই কালীমূর্তি উদ্ধার হয়েছিল।

nayekali ma

একদা দেবীর মন্দিরের চারপাশে ছিল গভীর জঙ্গল। জঙ্গল নাকি এতটাই গভীর ছিল সূর্যের আলোও প্রবেশ করতে পারত না। ছিল বিরাট নোনা জলের খাল। মন্দিরের কাছাকাছি অঞ্চলে খালের জল মিষ্টি হয়ে যেত। দূর-দূরান্ত থেকে বাসিন্দারা নৌকো করে জলপথে মন্দিরে পুজো দিতে যেতেন। স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই পুজো শুরু হয়। শোনা যায়, ঘন জঙ্গলে ছিল তেঁতুল গাছ। সেই গাছের কোটরেই পাওয়া গিয়েছিল নায়েকালী। স্থানীয়দের মতে, এই মন্দির সিদ্ধপীঠ। ভক্তদের বিশ্বাস, এই মন্দিরের দেবী অত্যন্ত জাগ্রত। পুণ্যার্থীরা বলেন, দেবীর কাছে যাঁরা আসেন, তাঁদের মনোবাঞ্ছা পূরণ হয়। দেবী নায়েকালীই ছিলেন বিস্তীর্ণ অঞ্চলের লোকেদের ভরসা। স্থানীয়দের কারও কারও দাবি, দেবী নায়েকালী বেলগাছ থেকে উঠে এসেছিলেন।

আরেকটি জনশ্রুতি রয়েছে। বহুকাল আগে মাছ ধরতে যাওয়ার পথে শঙ্করপুর মোহনায় প্রবল ঝড়ের মুখে পড়ে মৎস্যজীবীদের নৌকো। তালগাছের গুড়ি দিয়ে তৈরি ডিঙি নৌকোয় মাছ ধরা হত সেকালে। বিপদে পড়ে মা কালীকে স্মরণ করেছিলেন মৎস্যজীবীরা।

কথিত আছে, তাঁরা আশ্চর্যনজনকভাবে নৌকোডুবি থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। তারপর মাঝিকে মা কালী স্বপ্নাদেশ দেন। বলেন, সেখানেই তাঁকে প্রতিষ্ঠা করে পুজো শুরু করতে। জঙ্গলের মধ্যে খড়ের চালার মাটির ঘরে মা কালীকে প্রতিষ্ঠা করেন মাঝি। পরবর্তীকালে রামনগরের বালিসাইয়ের বারভুঁইয়াদের আমলে পাকা মন্দির তৈরি হয়। যদিও সেই মন্দির বহুকাল আগে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। তারপর বেশ কয়েক দশক টালির চালার ছোট পাকার মন্দির ছিল। স্থানীয় পণ্ডা পরিবার বংশানুক্রমিক মন্দিরে পৌরহিত্য করে আসছেন। প্রতিদিন নিত্যপুজো হয় এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ পুজো দিতে আসেন। ক্ষীরভোগ ও অন্নভোগ দিয়ে পুজো করা হয় নায়েকালীর। প্রতিদিন নিত্যপুজো হয়। এখানে মূল প্রসাদ হল ক্ষীরভোগ।

দীঘা-শৌলা মেরিন ড্রাইভের পাশে নায়েকালী মন্দির। দীর্ঘকাল ধরে ছোট মন্দির ছিল। কয়েকবছর আগে গ্রামবাসীদের আর্থিক সহায়তায় সুদৃশ্য এবং সুউচ্চ সাদা রঙের মন্দির তৈরি হয়। যাঁরা স্বপ্নাদেশ পেয়ে পুজো শুরু করেছিলেন, আজও তাঁদের হাতেই পূজিতা হচ্ছেন মা। ভক্তরা বংশ পরম্পরায় দেবীকে ভোগ দিচ্ছেন। তাঁরা দেবীর জন্য ভোগ তৈরি করে নিয়ে আসেন।

দুর্গা পুজোর সপ্তমী, অষ্টমীতে বেশ বড় করে পুজো হয় মন্দিরে। বাৎসরিক পুজো হয় দোলযাত্রার সময়। দোলপূর্ণিমার সময় নায়েকালীর বড় করে পুজো হয়। এক অলৌকিক ক্ষমতাবলে প্রতিদিন দেবীর অন্নভোগের ব্যবস্থা হয়ে যায়। এই মন্দিরের ভক্তদের কাছে রহস্য। বহু মানুষ এখানে মনস্কামনা পূরণের জন্য মানত করেন এবং পুজো দেন। দীঘা, শঙ্করপুর এলাকার অধিকাংশ ট্রলার, নৌকো, জেলেদের ডিঙি, লঞ্চ, স্টিমার নায়েকালী মন্দিরে পুজো দিয়েই সমুদ্রযাত্রা করে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...