উত্তর কলকাতা বলতে বোঝায় আড্ডা, পাড়া সংস্কৃতি, ব্যস্ততার মাঝেও একাত্মতা। আর এই উত্তর কলকাতা বলতেই যার কথা সবার আগে মনে আসে তা হলো সিনেমা পাড়া - হাতিবাগানের নাম। কলকাতার এমন একটি অঞ্চল হাতিবাগান, যেখানে সবকিছুর মধ্যে মিশে আছে সাহিত্য, খাওয়া-দাওয়া, আর আছে সিনেমা। মাত্র আধ কিলোমিটারের মধ্যে পরপর সিনেমা হল। টকি শো হাউস ফড়িয়াপুকুরে, একটু এগিয়ে এসে বিধান সরণিতে পা রাখলেই একে একে স্টার, দর্পণা, মিত্রা, মিনার, শ্রী, উত্তরা, রাধা, রূপবাণী। সে ছিল স্বপ্নপুরী। আর তার সাক্ষী দুপুর থেকে রাত উপচে পড়া ভিড়। তারপর সময়ের কালচক্রে বন্ধ হয়ে গেছে একের পর এক সিনেমাহল। ক্রমশঃ ম্রিয়মান হয়েছে সেই হৈহৈ শব্দ। আজও বন্ধ হলগুলো সেই স্মৃতি উস্কে দেয়।
উত্তর কলকাতার এই ব্যস্ত পাড়া হাতিবাগানের নাম ও জন্ম নিয়ে বেশ কিছু জনশ্রুতি আছে। বাংলায় হাতি শব্দের অর্থ ‘হস্তি’ আর বাগান মানে ‘উদ্যান’। ১৭৫৬ সালে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলা যখন কলকাতা আক্রমণ করেন, সেইসময় নবাবের হাতিগুলিকে এই অঞ্চলের একটি উদ্যানে রাখা হয়। অন্য মতে, এই অঞ্চলে ‘হাতি’ পদবীধারী জনৈক ব্যক্তির একটি বাগানবাড়ি ছিল। সেখান থেকেই হাতিবাগান নামটি এসেছে। মেহতাব চাঁদ মল্লিক পরে সেই বাগানবাড়িটি কিনে নেন। এই মেহতাব চাঁদ মল্লিকই হাতিবাগান বাজারটি প্রতিষ্ঠা করেন। এখনও কিন্তু সেই বাজার জাঁকিয়ে নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখে চলেছে। এখনও এই অঞ্চলে বহু ঐতিহ্যবাহী দোকান দেখতে পাওয়া যায়। আর এই বাজারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ফুটপাথের নানা পসরা। সিনেমাপাগল দর্শকরা শুধুমাত্র সিনেমাই নয়, থলিতে ভরে নিতেন দৈনন্দিন সামগ্রী বা প্রসাধনী। অবশ্য তার সাথে ছিল রসনাতৃপ্তি। এখনও শহরের প্রবীণ নাগরিকরা স্মৃতিচারণ করেন যে তাদের হাতিবাগানের অন্যতম আকর্ষণ ছিল রাধার পাশে গোপাল মিষ্টান্ন ভান্ডারের লুচি-ডাল কিংবা জোনাকির বা তৃপ্তির ফিস ফ্রাই।
ঐতিহ্যবাহী এই হাতিবাগানের সাথে কত ঐতিহ্য যে জড়িয়ে আছে তার ইয়ত্তা নেই। এখনকার ষ্টার থিয়েটার একসময় ছিল নাট্যমঞ্চ। পরবর্তীকালে সরকারের হস্তক্ষেপে তা সিনেমাহলের আকার নিয়েছে। সে যাই হোক গিরিশচন্দ্র ঘোষের একাধিক নাটক এখানে মঞ্চস্থ হয়েছিল। রামকৃষ্ণ পরমহংসও একাধিকবার এই নাট্যমঞ্চে নাটক দেখতে আসেন। হাতিবাগানের শতাব্দীপ্রাচীন বাজারটি বাংলার রেশম ও তাঁতের শাড়ির জন্য বিখ্যাত। শোনা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি বিমানবাহিনী হাতিবাগানে একটি বোমা ফেলেছিল। কিন্তু সেটি না ফাটায় কোনোরকম ক্ষতি হয়নি।
বলতে দ্বিধা নেই হাতিবাগান পুরোনো কলকাতার ধারক। একটু ভাবলেই দেখা যায় এই পুরো অঞ্চলটাতেই কিছু বিশেষ ব্যক্তিত্বের আবাস স্থল ছিল এমনকি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আনাগোনা ছিল। যার সাথে ইতিহাস ও ঐতিহ্য মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। কিন্তু এই হাতিবাগানের নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য কটা লোক জানেন ! তা হয়তো আধুনিক প্রজন্ম জানেই না । কিন্তু এর ঐতিহ্যর সাথে তাদের পরিচিতি প্রয়োজন।