যারা ইতিহাস নিয়ে খানিক কৌতুহলী তাদের অনেকের মনেই এমন প্রশ্ন থাকে, যে আমাদের দেশে যারা সম্রাট, নবাবরা ছিলেন, যাদের অঢেল ঐশ্বর্যের ও সমৃদ্ধির স্মারক হয়ে আছে নানা সৌধ , স্থাপত্য - দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের বংশধররা কোথায় গেলেন? তারা এখন আছেন কোথায়? তাদের অবস্থা এখন কেমন! এখনো কি তারা সমান সম্পদশালী! না কি কালপ্রবাহে তাদের অস্তিত্ব আজ সংকটে বা একমাত্র স্মৃতির লেবেল ছাড়া আর কোনো সম্বল নেই - এসব প্রশ্ন হওয়া স্বাভাবিক।
আর কলকাতার ইতিহাস যারা খানিক জানেন তাঁদের কাছে ওয়াজেদ আলী শাহ (অযোধ্যার নবাব) নামটি কিছুমাত্র অজানা নয়। তাঁর রসবোধ, সঙ্গীতের প্রতি আকর্ষণ, ভোজন রসনা, বিরিয়ানিতে আলুর প্রচলন, কচ্চি টিক্কা কাবাব সহ একাধিক গুণাবলীর কথা জানা। কিন্তু তাঁর ২৫০ জন স্ত্রী এবং ৪৮ জন সন্তানদের কথা হয়তো বা অনেকের অজানা। তাঁরা এখন কোথায়, কি করেন ! এখনো কেউ কি আছেন যিনি আক্ষরিক অর্থে নবাব! সেই অজানা তথ্যেরই আজ সন্ধান করবো।
নবাবের প্রকৃত উত্তরাধিকারী বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে একাধিক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে নানা জীবন্ত কাল্পনিক চরিত্র, যারা নবাবের বংশধর বলে দাবি করেছেন। তথ্যানুযায়ী নবাবের বংশধররা আজও আছেন কলকাতা, লখনউ, পাকিস্তান জুড়ে। তাঁদের নিজেদের মধ্যে আছে যোগাযোগ। তেমন একজন হলেন মঞ্জিলত ফাতিমা, তাঁর মতে তাঁর বাবা কাউকাব কাদির এখন অযোধ্যার জীবিত নবাব। কিন্তু হঠাৎ নিজেদের নবাবী অস্তিত্ব দাবি করার কি কারণ হলো? ২০১৭ তে নিউ দিল্লির রজা আলি নামক এক ব্যক্তির মৃত্যু সেই বিতর্ককে আবার উস্কে দেয়। যদিও এর সূত্রপাত করেন ৫০ বছর আগে তাঁর মা বিলায়েৎ মহল। তিনি হঠাৎ দিল্লি স্টেশনে রজা আলি এবং তার বোন সাকিনা কে নিয়ে এসে দাবি করেন যে তাঁর ছেলে অযোধ্যার প্রিন্স, ওয়াজেদ আলী শাহের প্রকৃত বংশধর। এমনকি সরকারের কাছে তাঁদের ব্রিটিশ সরকারের বাজেয়াপ্ত সম্পত্তির ক্ষতিপূরণ ও দাবি করেন। যদিও কোনো বৈধ নথি দেখতে পারেন নি। দীর্ঘ ৯ মাস দিল্লী স্টেশন এ থাকার পর রাজীব গান্ধীর উদ্যোগেই রাইসিনা হিল পরিবেষ্টিত মালঞ্চ গ্রামে একটি বাড়ির ব্যবস্থা করা হয়।
কিন্তু এই বংশের সদস্যদের দাবি অনুযায়ী তারা সরকারের কাছ থেকে পেনশন পান তার বৈধ নথিও তাদের আছে। জানা যায় এই বংশধরেরা কেউই ‘প্রিন্স’ শব্দের প্রয়োগ করেন না, মঞ্জিলত ফাতিমার বাবা - ই শেষ নবাব। যিনি জীবিত। রাজত্ব নেই, রাজকীয়তাও ঢাকা পড়েছে, এমনকি সে অযোধ্যাও নেই, কিন্তু বংশধর হিসেবে প্রমান দাখিল করতে এখনো ৮৮ বছরের আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ অধ্যাপকের অস্তিত্ব মানতেই হবে। তার মতে রাজবংশে বিলায়েতের কোনো অস্তিত্ব নেই। বিশেষ উল্লেখ্য যে, ‘মহল’ কোনো নাম নয় এটা সম্মানসূচক পদবি। নবাবের উত্তরাধিকার জন্মের পর স্ত্রীদের সম্মাননায় এই মর্যাদাসূচক পদবি দেওয়া হতো। এই বিষয়টা আলী রজা বা তার মা জানতেন না। নবাবের প্রকৃত বংশধরদের সত্য উদ্ঘাটনে সাহায্য করেন বিদেশী সাংবাদিক এলিন ব্যারি। যিনি দায়িত্ব নিয়ে একাধিক নথি ও তথ্য জোগাড় করে দেখান যে, বিলায়েত পাকিস্তান থেকে আসেন মিথ্যে দাবি নিয়ে, তাঁর মানসিক স্থিতিও ছিল বিকারগ্রস্থ, আর বিদেশী সংবাদ মাধ্যম, সাংবাদিকরা এই বিষয়টিকে উত্থাপন করে বিতর্কের সৃষ্টি করে। আর সেই সুযোগই তিনি নেন। যার সমাপ্তি ঘটান এই প্রবীণ সাংবাদিক।
প্রাপ্ত বংশ তালিকা খানিক এমন :
ওয়াজেদ আলী + বেগম হজরত মহল
নবাব বির্জিস কাদির
মেহের কাদির
আনজুম কাদির কাউকাব কাদির নয়ার কাদির
(জীবিত নবাব )
এরা সরকারি পেনশন ভুক্ত, কিন্তু এই তালিকায় কোনো বিলায়েতের নাম নেই, তাদের দাবি এই বিষয়টা সম্পূর্ণ প্রতারণা, সরকার যেন এই বিষয়টার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করেন। কিন্তু আজ আর তার সুযোগ নেই। নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যান রজা আলী, মুসলিম ওয়াকফ বোর্ড তাঁকে সমাহিত করেন।
যাই হোক তাঁরা আজ বিলুপ্ত, মালঞ্চ মহল আজ হানা বাড়ি। কিন্তু প্রকৃত সদস্যরা আজও আছেন। তাদের একজনের কথা আগেই বলেছি মঞ্জিলত ফাতিমা, অন্যজন ফাতিমা মির্জা। এছাড়াও আরো অনেকেই আছেন, যারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিঠিত। তবে এই নাম দুটি বেশি পরিচিত কারণ তাঁরা তাঁদের নবাবী ঐতিহ্যকে রন্ধন শৈলীর মাধ্যমে বয়ে নিয়ে চলেছেন সাফল্যের সাথে। এরজন্য তাদের না মহল, না রাজকীয়তার প্রয়োজন আছে। আছে শুধু নবাবী ঐতিহ্যের সত্ত্বা। আর এই নবাবের প্রোপৌত্রীর নবাবিয়ানার সাক্ষী হতে হলে ঘুরে আসতে পারেন ‘মঞ্জিলত’-এ, পাবেন আজও অযোধ্যার নবাবী খাবারের স্বাদ।