ব্যথা মানুষের চিরসাথী। আজ হাঁটুর ব্যথা তো কাল কোমরে ব্যথা। পরশু গলায় ব্যথা তো তার পরের দিন পায়ে ব্যথা। আর এই ব্যথার সাথে যুঝেই আমাদের চলতে হয় প্রতিনিয়ত। বাজার চলতি নানা ওষুধপত্তর আমরা পেইন কিলার হিসেবে ব্যবহার করে থাকলেও সেই পেইন কিলার পরোক্ষভাবে মানুষের শরীরের অধিক ক্ষতি করতেই ব্যস্ত। তাহলে ব্যথা কমানো যায় কিভাবে? কিছু ঘরোয়া উপায় যদি অবলম্বন করা যায় এই ব্যথা কমানোর জন্য তাতে কি লাভ হয় আদৌ? নাকি তাও প্রচলিত ধারণা মাত্র? এখন বাজারে ব্যথা কমানোর জন্য পাওয়া যাচ্ছে নানা আয়ুর্বেদিক তেল। দাবি করা হয় এই তেল ব্যথা কমানোর জন্য উপকারী। চলুন এইসব বাদ দিয়ে আমরা এমন কিছু জিনিস নিয়ে আজ আলোচনা করি যা ব্যথা তো কমাবেই এবং সামগ্রীগুলি আপনি খুব সহজেই হাতের কাছেই পেয়ে যাবেন। হাতের কাছে পাওয়া যায় এমন কিছু উপাদান যেগুলি প্রাকৃতিক পেইন কিলার হিসেবে ব্যবহার করা যায় তা হলো-
১) হলুদ- বাঙালির ঘরের প্রতিটি রান্নায় হলুদের ব্যবহার অপরিহার্য। হলুদ রান্নার স্বাদ বৃদ্ধি করতে ব্যবহার করা হলেও অনেকক্ষেত্রেই রান্নায় হলুদ দেওয়া হয় হলুদের আয়ুর্বেদিক গুণের জন্য। বলা হয় রান্নায় স্বাদ বাড়ানোর সাথে সাথে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়াতে সাহায্য করে এই হলুদ। বহুযুগ আগে থেকেই হলুদ আয়ুর্বেদিক ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি ছাড়াও কোষের মধ্যে ফ্রি রেডিক্যালের ড্যামেজ রোধ করে ফলে এই স্থানে ড্যামেজের ফলে তৈরী হয় ব্যথার উপশম ঘটে। যেকোনো স্থানে ব্যাথার মূল কারণ হলো সেই স্থানের ইনফ্লেমেশন। হলুদের মধ্যে থাকা অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট এবং হলুদের বিশেষ অ্যান্টি ইনফেলমেটরি ধর্ম ক্ষতস্থানের ইনফ্লেমেশন কমাতে সাহায্য করে থাকে।
২) উইলো বার্ক- অর্থাৎ উইলো গাছের ছাল বাজারচলতি পেইন কিলারের মতোই কাজ করে থাকে কারণ এই ছালে থাকে স্যালিসিন যা প্রাকৃতিক পেইন কিলার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অ্যাসপিরিনে থাকা অ্যাসিটাইল স্যালিসাইলিক অ্যাসিডের ক্লোজ রিলেটিভ স্যালিসিন ব্যথা উপশমকারী ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আগেকার দিনে মানুষ এই গাছের ছালকে মুখে নিয়ে চিবাতো। আর এই ছাল চেবানোর ফলে জ্বর থেকে শুরু করে গা-হাত-পা ব্যথা, গা ম্যাজম্যাজ করা প্রভৃতি কমতো। এখনকার দিনে সেই জিনিসই ক্যাপসুলের আকারে বাজারে উপলব্ধ।
৩) ইপসম লবন- সবসময় ব্যথা বা অন্য কোনো শারীরিক অসুস্থতার কারণে ওষুধই খেতে হবে এমন কোনো কারণ নেই। কখনো কখনো ওষুধের প্রলেপও ব্যথার উপশমে অন্য ভূমিকা গ্রহণ করে। সেরকমই একটি উপাদান হলো ইপসম লবন। গরম জলে ইপসম লবন ভিজিয়ে ব্যথার জায়গায় সেই জল লাগাতে পারলে উপকার মেলে। একটি পুঁটলিতে ইপসম লবন নিয়ে সেই পুটলি জলে ভিজিয়ে পিঠের বা কোমরের ব্যথার জায়গায় লাগান। আজকাল বেশিরভাগ বাড়িতে আর্থ্ররাইটিসের ব্যথার জন্য এই টোটকাটি অনেকেই ব্যবহার করে থাকে।
৪) হাড়ের স্যুপ- বাড়িতে মাংস আসলেই বাচ্চারা যে জিনিষটির উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তা হল মাংসের হাড়। অনেকসময় বাজার থেকে মাংস কেনার সময় লোকজন হাড় বাদ দিয়ে শুধু নিট মাংসই কিনে আনেন। এই শুধু মাংস কিনে আনাটা কিন্তু একটু ভুলই। কেন বলুন তো? সেই হাড়ই যে ব্যথা কমানোর এক ঘরোয়া উপাদান তা হয়তো অনেকেরই জানা নেই। বাইরের দেশে এই হাড়ের স্যুপ বেশ জনপ্রিয় হলেও আমাদের দেশে এর তেমন জনপ্রিয়তা নেই। কিন্তু এই স্যুপে উপস্থিত থাকে কোলাজেন থেকে শুরু করে প্রোলিন, গ্লাইসিন এবং গ্লুটামিন। হাড়ের মধ্যে থাকা এইসব উপাদান ব্যথার এক উত্তম ঔষধি হিসেবে কাজ করে।
৫) লবঙ্গ- লবঙ্গের তেল দাঁতে ব্যথার জন্য অনেকেই ব্যবহার করে থাকে। বলা হয়, ঝাঁঝালো এই হার্বটি ব্যথার উপশমে অন্যতম ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। লবঙ্গ খেলে বা ব্যথার জায়গায় লাগালে দুই ক্ষেত্রেই উপকার মেলে। অনেক মানুষই বহুদিন থেকে মাথার যন্ত্রনা এবং আর্থ্রাইটিসের জন্য লবঙ্গ ব্যবহার করে আসছেন। বলা হয়, যেকোনো রকমের ফাঙ্গাল ইনফেকশনের জন্যেও লবঙ্গ খুব উপকারী। লবঙ্গতে থাকা ইনফ্লেমেটরি উপাদানের নাম হলো ইউজিনল। বাজারচলতি পেইন কিলার মলমগুলিরও অন্যতম একটি উপাদান হল এই ইউজিনল। লবঙ্গের তেল সরাসরি দাঁতে ব্যথা হলে সেই মাড়ির মধ্যে লাগানো যায়। তবে অতিরিক্ত লবঙ্গের তেল ব্যবহারের ফলে ত্বকের ক্ষতিসাধন হওয়ার আশঙ্কাও থাকে।
৬) গরম এবং ঠান্ডা- ব্যথা কমানোর ক্ষেত্রে সমস্ত মানুষ প্রথম যেই পদ্ধতিটির উপর ভরসা রাখেন তা হলো গরম এবং ঠান্ডা। আর্থ্ররাইটিসের ব্যথার ক্ষেত্রে যেমন এক এক জনের এক এক রকম পদ্ধতির প্রয়োজন পরে। যেমন কারোর ক্ষেত্রে ঠান্ডা কম্প্রেশন তো কারোর ক্ষেত্রে গরম কম্প্রেশন উপকার দেয়। পায়ে বা গোড়ালিতে চোট লাগলে একটি গামলায় ঠান্ডা জল এবং একটি গামলায় গরম জল নিন। এবার একবার পা ডোবান গরম জলে এবং একবার পা ডোবান ঠান্ডা জলে। বহুদিন ধরেই এই পদ্ধতিটি চলে আসছে তাই এই পদ্ধতিটি মোটামুটি সকলেরই জানা।
এখানে আমরা মোট ছয় রকমের পদ্ধতি বা সামগ্রী নিয়ে আলোচনা করলাম যা ব্যথা কমানোর জন্য উপকারী বলে ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে। তাই কোথাও ব্যথা লাগলে চটজলদি বাজার থেকে পেইন কিলার কিনে না এনে প্রথমে এই পদ্ধতিগুলির ব্যবহার করে দেখুন। এতে যদি না কমে তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং চিকিৎসকের প্রেস্ক্রাইব করা পেইন কিলারই খান। কিন্তু এটা সবসময় মনে রাখবেন অতিরিক্ত পেইন কিলার খেলে লিভারের ক্ষতি কিন্তু অনিবার্য। তাই ঘরোয়া পদ্ধতিগুলি একবার ট্রাই করে দেখতেই পারেন।