'আ'-য়ে আমের আস্বাদ

ভারতবর্ষে তখন মোঘলদের রাজত্ব চলছে। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে সম্রাট বাবর অত্যন্ত সৌখিন মানুষ ছিলেন। একবার মোঘল সম্রাট বাবরের দুপুরের খাবারের পর শেষ পাতে বেশ অন্যরকম কিছু খেতে ইচ্ছে হলো। সম্রাটের অত্যন্ত পছন্দের ক্ষীর থেকে শুরু করে নানা রকম মিষ্টি দেওয়া হল।

রাজার রসনা তৃপ্তি বলে কথা! পেট ভরলেও মন ভরে না। সম্রাটের বাবুর্চি তখন অতৃপ্ত মনের রাজাকে তৃপ্ত করলেন একটা ফল দিয়ে। কমলা-হলুদ রং। ভারী মিষ্টি গন্ধ। গন্ধেই অনেকখানি মন ভরে যায়। তারপর খাওয়ার থালা থেকে রাজার জিহ্বা অব্দি পথ নিমেষে শেষ হয়ে গেল। এরপর থেকে নাকি মরসুম এলেই নিয়ম করে এই ফল পাতে পড়তো খোদ সম্রাটের। এই ফলের প্রতি সম্রাটের ভালোবাসা এতটাই গভীর ছিল যে 'বাবরনামা'তেও সম্রাটের আম-প্রীতির উল্লেখ রয়েছে।

এভাবেই যুগ যুগ ধরে রাজা-উজির থেকে 'আম' আদমির মন জয় করে চলেছে আম। এককথায় ফলের রাজা। যার সঙ্গে আছে স্বাদের বাহার।

সারাবিশ্বে প্রায় পাঁচশ রকমের আমের প্রজাতি আছে। বেশিরভাগই গরমে পাকে। তবেই আমের কয়েকটি প্রজাতি বছরে দুবার ফলন দেয়।

আম পরিবারের সবচেয়ে মূল্যবান সদস্য মনে করা হয় আলফানসোকে। সারা বিশ্বে আলফানসো প্রজাতির আমের চাহিদা সবচেয়ে বেশি।

বৈশাখের শুরুতে কাঁচা, তারপর ধীরে ধীরে প্রকৃতি, হরমোন আর বিজ্ঞানের সাহচর্যে পাকতে শুরু করে সে। আর সেই পাকা আম স্বাদ, গন্ধ, বর্ণ সবকিছুকে ছাপিয়ে মানুষের অন্তরে পৌঁছে যায়।

mango1

রসালো, মিষ্টি এই ফল তার স্বাদের মাধ্যমে সমাজের শ্রেণী বিভাজনের ঊর্ধ্বে। যে কোন আর্থিক অবস্থার মানুষই আমের স্বাদের ভাগ নিতে পারে তার পকেট সামলে। আম একেবারেই 'আম-আদমি'র হাতের মুঠোয় থাকে। এই দুর্মূল্যের বাজারে আমের বেশ কয়েকটা প্রজাতি এখনো কম দামে কিনতে পাওয়া যায়।

আম নিয়ে একটি লোককাহিনী প্রচলিত আছে। একবার ইরানের বাদশা বিশ্ব জয় করে এসে পৌঁছলেন বাংলায়। গ্রীষ্মকাল। তখন অবিভক্ত বাংলা। গ্রীষ্মকালে বাংলা আর আম একে অপরের পরিপূরক। তাই উজির মহাশয় বাদশাকে খুশি করতে তাঁকে আম খাওয়ালেন। ব্যাস আর যায় কোথায়! উজিরের ওপর নির্দেশ এল ইরানের বাদশা যতদিন বাংলায় থাকবেন তাঁকে নিয়ম করে আম খাওয়াতে হবে।

এ নিয়ে রয়েছে একটি মজার ছড়া

'' দেখো রে উজির! তুমি জানিয়া জানো না,

সাত দিবসের মধ্যে যদি তুমি আম না খাওয়াইতে পারো,

তবে তোমার কাটিবে গর্দান।"

না , সে উজিরের কি হয়েছিল সেই তথ্য কোথাও পাওয়া যায় না, কিন্তু আম যে রাজার কতখানি প্রিয় ছিল তা বোঝা যায়।

আমের প্রতি বিশ্ববাসীর এই ভালোবাসাকে সম্মান জানাতে প্রতি বছর বাইশে জুলাই জাতীয় আম দিবস পালিত হয়। কানাডা, ফিলিপিন্সের মতো দেশে প্রতি বছর গরমকালে আম উৎসব পালিত হয়। সারা বিশ্বের আম উৎপাদনকারীরা আসেন এখানে। আমের নানা রেসিপির প্রদর্শন হয়।

ধারণা করা হয় আমের উৎপাদন শুরু হয়েছিল প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। উত্তর-পূর্বের ভারত ও মায়ানমার সংলগ্ন এলাকায় প্রথম আমের উৎপাদন শুরু হয়েছিল। ভারত, পাকিস্তান ও ফিলিপিনস এই তিনটি দেশের জাতীয় ফল আম। বাংলাদেশের জাতীয় বৃক্ষ আম গাছ।

তবে এই ফল তার স্বাদ, গন্ধ, রং-এর মাধ্যমে কোন নির্দিষ্ট দেশের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই আর। সারা বিশ্ব জুড়েই এর আমদানি ও রপ্তানি চলে।

সমগ্র বিশ্বে ৫৬ মিলিয়ন টন আম উৎপাদন হয়। এশিয়া প্রথম আম উৎপাদনে।

বিশ্বে আম উৎপাদনে শীর্ষ দেশ ভারত। প্রতি বছর বিশ্বের প্রায় ৪০% আম শুধু ভারতেই উৎপাদিত হয়। তবে ভারতের নিজের চাহিদা মিটিয়ে খুব বেশি আম রপ্তানি করা সম্ভব হয় না।

mango2

ইন্দোনেশিয়া, চীন, মেক্সিকো পাকিস্তান ও ব্রাজিলেও আম উৎপাদন বেশ উচ্চমাত্রায়।

ইতিহাসের সঙ্গে আমের যোগসূত্র বড়ই গভীর। প্রায় প্রত্যেক মোঘল সম্রাট আমের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। সম্রাট আকবর একবার বিহারের দ্বারভাঙ্গা অঞ্চলে এক লাখ আমগাছের একটা বিরাট বাগান করেছিলেন। জাহাঙ্গীর, শাহজাহানও দিল্লি লাহোরে আম বাগান করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমের নানা রেসিপির উদ্ভবও সেই সময়ই।

মহাকবি কালিদাস পার্বতীর ঠোঁটের আমাকে তুলনা করেছেন আমের কচি পাতার রং এর সঙ্গে। কবি ও দার্শনিক আমির খসরু আমের জন্য ব্যবহার করেছেন তাঁর ভালোবাসার পংক্তি: ''নাগজা তারিন মেওয়া হিন্দুস্তান" অর্থাৎ হিন্দুস্তানের সবচেয়ে সুন্দর ফল।

আর কবিগুরুর বলেছেন-
"আমসত্ত্ব দুধে ফেলি
তাহাতে কদলি দলি
সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে
হাপুস হুপুস শব্দ চারিদিক নিস্তব্ধ
পিঁপড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।"

পল্লীকবি জসীমউদ্দীন আমের সঙ্গে আমাদের অন্তরের টান খুঁজে পেয়েছেন:

"ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়াতে সুখ,

পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করি মুখ,"

কাজী নজরুল ইসলামও আম নিয়ে কৌতুক গান রচনা করেছিলেন।

বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে আমের যোগসাজশ এই ফলের মতই মিষ্টি। বৌদ্ধধর্মের প্রত্যেক আচার-অনুষ্ঠানে আম্রপল্লব প্রয়োজন হয়। আমাদের বাঙ্গালীদের ক্ষেত্রেও বেশিরভাগ পুজোর অনুষ্ঠানেই আম্রপল্লব-এর প্রয়োজন হয়।

সাহিত্য, ধর্ম , সংস্কৃতি , সৌজন্যতা, হৃদ্যতা এই সব ক্ষেত্রকে এক সূত্রে বেঁধেছে এই একটি ফল। আম।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...