টানা দাঁড়িয়ে। বসার উপায় নেই। বসলেই ছিঁড়ে যেতে পারে বর্ম। মাস্ক ঢাকা মুখ।কোনওভাবেই খোলা যাবে না। তাই খাবার বা জল সব বন্ধ। এমন কী শৌচাগারেও যাওয়া যাবে না। সারাক্ষণ পরে ফ্যান তো দূরের কথা এসির বাতাসও প্রবেশ করতে অক্ষম বর্মের অন্দরে। একমুহুর্তও পিপিই খুলে রাখার উপায় নেই। দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কেটে যায় এভাবেই। প্রতিদিন অনেকটা সময় চলে যায় বর্ম পরা আর উতরানোতে। কফি, আড্ডা, কথাবার্তা, ফোন কিংবা নেহাত কেমন আছ- সবই বন্ধ। হাসপাতাল এসো। পরিষেবা দাও। চলে যায়।
প্রতিমূহুর্তে সংক্রমণের ভয়। ‘আজ ঠিক আছি, কাল কেমন থাকব তা জানা নেই’- এই সত্যি মাথায় রেখেই দিনের পর দিন যুদ্ধের ময়দানে ওঁরা। প্রতিপক্ষ করোনার সঙ্গে লড়াই চলছে চোখে চোখ রেখে।
পৃথিবীর মানুষ সুপারহিরোদের শুধু কল্পনায় দেখেছে। সেখান থকে বই বা সিনেমার পর্দায়। কিন্তু অতিমারী দেখিয়ে দিল মানুষকে আসল সুপারহিরো কারা।
তাদের ভয়ডর থাকতে নেই। প্রাণের মায়া তুচ্ছ। পাখির চোখ শুধু জীবন বাঁচানোর লড়াইতে। অনেকসময় ঢাল-তরোয়াল কিছুই থাকে না। তবু যুদ্ধটা লড়ে যেতে হয়। ভরসা আত্মবিশ্বাস।
রাতারাতি বদলে গিয়েছে ওঁদের দিনরাত। শুধু এদেশ নয়, সারা বিশ্বের ডাক্তারদের প্রতিদিনের রুটিনটা রাতারতি বদলে দিয়েছে করোনা।
বিরতিহীন একটানা রোগী সামলাবার ‘ডিউটি’। এক অজানা রোগের অসম সংগ্রাম। প্রতিমুহুর্তে রূপ বদল করছে সে। কিন্তু আত্মসমর্পন করবে না তার কাছে। সম্ভাব্য সব রকম অস্ত্র দিয়ে তাকে কাবু করার চেষ্টা। বদলে গিয়েছে রোগীদের সঙ্গে সম্পর্কও। আগে চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে কথাবার্তা চলত তাদের সঙ্গে। তৈরি হত সৌজন্যের সম্পর্ক। এখন আর সে সুযোগ নেই। সারাক্ষণ ভাইরাস সংক্রমণের ভয়।
চ্যালেঞ্জটা ঘরে বাইরে
আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে সংক্রমিত হওয়ার। বাড়ির লোক, বন্ধু, চেনা পরিচিতদের উদ্বেগ বাড়ে। নিজের মধ্যেও দুশ্চিন্তা। বাড়ি ফিরে পরিবারের লোকের সময় কাটাবার অবসরটাও বদলে গিয়েছে। পরিবারের বয়স্ক সদস্য আর শিশুদের থেকে দূরে থাকতে হয়। কিছুই নেই আর আগের মতো।
ইউরোপ আমেরিকার মত প্রথম সারির দেশগুলোতে যখন মৃত্যু মিছিল চলছে তখনও দেশবাসীর মনে সাহস যুগিয়েছেন ওঁরা। সাধারণের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘ভয় নেই, আমরা আছি। আপনারা শুধু আমাদের সাহায্য করুন’। করোনাকে দূরে রাখার জন্য ওঁদের বার্তা ‘উই আর স্টেইং অ্যাট ওয়ার্ক ফর ইউ, ইউ স্টে অ্যাট হোম ফর আস’।
অতিমারী ঠিক কতটা ভয়াবহ সামনে থেকে প্রতিদিন দেখে চলেছেন তার রূপ। তবু নিজেদের কাজে নিবেদিত প্রাণ। ভারতে প্রথম করোনা আক্রান্তের সন্ধান পাওয়া যায় ৩০ জানুয়ারী। করোনা আক্রান্ত হয়ে ভারতে এখনও পর্যন্ত ৭০ চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে। সরাসরি করোনা রোগীর চিকিৎসায় যুক্ত ছিলেন, অথবা কোনও না কোনওভাবে চিকিৎসার খাতিরেই সংস্পর্শে এসেছিলেন। যদিও ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন মৃত চিকিৎসকদের নাম এবং তথ্য প্রকাশ করেনি। তবে চিকিৎসকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার দিকটি অত্যন্ত জরুরী বিষয় হিসেবে গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে।
অসম যুদ্ধে ভয় অনেক। পৃথিবীর কোনও দেশই অতিমারীতে চিকিৎসকদের আক্রান্ত হওয়ার পরিসংখ্যান যথাযথ ভাবে সামনে আনতে পারেনি। ইতালি, স্পেন, আমেরিকা বা ব্রিটেন ছবিটা যে দেশেরই হোক অবস্থাটা একই।
তবে যাদের নিয়ে এত কথা, পরিসংখ্যান নিয়ে দ্বন্দ্ব, তাদের কিন্তু সময় নেই এত কিছু চিন্তা করার। তারা শুধু জানে যেভাবেই হোক যুদ্ধটা জিততে হবে। প্রাণ বাঁচানোর এই যুদ্ধে তারা এক এক জন যে এক অক্ষৌহিনী সেনা!