আজকের কালী কথায় হাওড়ার এক কালীর কাহিনী। মন্দিরটি ডোমজুড়ের নারনা গ্রামে অবস্থিত। এই ডোমজুড়ের ইতিহাস কিন্তু সুপ্রাচীন। ডোম সেনাদের বীরত্বের কাহিনীর বলা ভাল বীর গাথার সাক্ষী ডোমজুড়। একদা ডোম সেনারা দেশীয় রাজাদের হয়ে নানান লড়াই লড়ত, কিন্তু কালের নিয়মে তারা হারিয়ে গিয়েছে। কিন্তু রয়ে গিয়েছে ডোমকল, ডোমজুড়ের মতো কিছু জনপদ। যাক সে অন্য কথা। আমাদের আজকের কালী কথায় উঠে আসবে নারনা কালী মন্দিরের কথা। মন্দিরের বয়স ২৫০ বছরেরও বেশি। কালী মন্দির ঘিরে নানান হাড় হিম করা জনশ্রুতি থাকে। তেমনই এ মন্দিরেরও এক রোমহর্ষক কাহিনী রয়েছে। লোকমুখে জানা যায়, এই মন্দিরের দেবী নাকি প্রতিদিন রাতে তাঁর পরিবার নিয়ে স্নান করতে যান। জনশ্রুতি অনুযায়ী, আজ থেকে ২৫০ বছর আগে স্থানীয় এক বাসিন্দা জঙ্গলে ঘেরা নারনা গ্রামের এক পুকুরে স্নান করতে নেমে ঘট খুঁজে পেয়েছিলেন। সেই রাতেই তিনি স্বপ্নাদেশ পান।
স্বপ্নাদেশে দেবী তাঁকে ঘটস্থাপন করতে বলেন। সেই সঙ্গে পুজো আরম্ভ করার নির্দেশ দেন। দেবী কালিকার নির্দেশ মতো, প্রথম কয়েক বছর ধরে ঘটপুজো করা হয়। তারপর একসময় দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তি স্থাপন করা হয়। আজ এই পুজো গ্রামের সকলের পুজো হয়ে গিয়েছে। নারনা গ্রামের মানুষজন আজও সময় পুজো ঐতিহ্য মেনে করে আসছে। আড়াইশো বছর ধরে তারা বয়ে নিয়ে চলেছেন পুজোর রীতি রেওয়াজ।
৬ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে কোনা হয়ে, জগদীশপুরের ওপর দিয়ে পৌঁছতে হবে এই মন্দির। মন্দিরে দেবী কালিকার সঙ্গেই রয়েছেন লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক, তারাও পূজিত হচ্ছেন। দেবী এখানে কালী রূপে বিরাজমান, কিন্তু দেবী দুর্গা রূপেই পূজিতা হন। ভক্তরা বলেন, নারনা কালী মন্দিরের দেবী কালিকা অত্যন্ত জাগ্রত। স্থানীয়দের কাছে দেবীর নানা মাহাত্ম্যর কথাও শোনা যায়। মন্দিরে সারা বছর দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা আসেন। দেবীর কাছে মানসিক করেন, মনস্কামনা পূর্ণ হলেই দেবীর পুজো দেন। মন্দিরের পাশেই রয়েছে একটি পুকুর। স্থানীয় বাসিন্দারা এই পুকুরকে কালী পুকুর বলেন। ভক্তদের কাছেও এটি কালী পুকুর নামেই পরিচিত। এই পুকুরে জাল ফেলা, জলে নামাসহ অন্য যেকোনও কাজকর্ম করা নিষিদ্ধ। কারণ, ভক্তদের বিশ্বাস এখানে প্রতিরাতে দেবী তাঁর সন্তানদের নিয়ে স্নান করতে আসেন। গতকাল ছিল গুড ফ্রাইডে। ওই দিন মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। তাই সেই দিনটিকে স্মরণে রেখে প্রতিবছর গুড ফ্রাইডের দিন সারারাত ধরে মন্দিরের বাৎসরিক কালী পুজো হয়। বাৎসরিক পুজোর সময় বিপুল ভক্ত সমাগম হয়। পুজো উপলক্ষ্যে এক সপ্তাহ ব্যাপী মেলা বসে। কীর্তন, গীতাপাঠ, যাত্রাপালার আয়োজন করা হয়। বাৎসরিক পুজোর দিন অন্নকূট উৎসব আয়োজিত হয়। মন্দির প্রাঙ্গণেই দুটি উনুন বানিয়ে ভোগ রান্না করা হয়। কথিত আছে, এই মন্দিরে ভক্তসংখ্যা যতই হোক না কেন, দেবীর আশীর্বাদে আজ অবধি কোনওদিন ভোগ কম পড়েনি।
বাংলার আরও একটি মন্দির ঘিরে এমন কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। সেখানেও প্রচলিত রয়েছে নিশুতি রাতে দেবী স্নান করতে বের হন। শিল্পনগরী দুর্গাপুরের গ্রামীণ অঞ্চল রয়েছে দেবী শ্বেতকালীর মন্দির। কথিত আছে, এই মন্দিরের দেবী অতিজাগ্রত। রোজ রাতে নাকি দেবী কালিকা নদীতে স্নান করেন। দুর্গাপুরের বিদ্যাসাগর পল্লিতে রয়েছে শ্বেতকালীর মন্দির। দেবীর গায়ের রঙ সাদা। মন্দিরটির রঙও সাদা। মন্দিরটি অত্যন্ত পুরোনো। জনশ্রুতি রয়েছে, কোনও এক সাধক মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন। প্রতিবছর আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথিতে দেবীর বাৎসরিক উৎসব পালন করা হয়। স্থানীয় তিনটি গ্রামের বাসিন্দারা মিলে দেবী শ্বেতকালীর পুজোয় অংশ নেন। পুজোর দিন সকালে সূর্য ওঠার আগে দই ও খই নিবেদন করে দেবীকে ভোগ দেওয়া হয়। দুপুরে দেওয়া হয় লুচি, সিমুই, মিষ্টি। রাতে পুজোর সময় ভোগ হিসেবে থাকে ফল, মিষ্টি, সাদাভাত, মুগডাল, পাঁচ রকমের ভাজা, তরকারি, চাটনি, পায়েস। শ্বেতকালী খুবই বিরল, রাজবলহাট, ব্যান্ডেল, শোভাবাজারে শ্বেতকালীর মন্দির দেখতে পাওয়া যায়।
দুর্গাপুরের শ্বেতকালী মন্দির ঘিরে জনশ্রুতির অন্ত নেই। কথিত আছে, আজও এখানে দেবী শ্বেতকালীর নূপুরের শব্দ শোনা যায়। মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে দামোদর। স্থানীয় বাসিন্দাদের বিশ্বাস এই দামোদর নদেই রোজ রাতে স্নান করতে যান দেবী শ্বেতকালী। স্থানীয় এক বাসিন্দা দাবি, তিনি নাকি প্রত্যক্ষভাবে সেই অভিজ্ঞতার সম্মুখীনও হয়েছেন। দুর্গাপুর অঞ্চলের আবহাওয়া খুবই কষ্টকর। খনি সমৃদ্ধ অঞ্চল হওয়ায়, দুর্গাপুরে অত্যন্ত গরম পড়ে। কথিত আছে, একবার তীব্র গরমে স্থানীয় এক বাসিন্দা মন্দিরের সিঁড়িতে রাতে শুয়েছিলেন। সেই সময় তিনি এক মহিলার কণ্ঠস্বর শুনতে পান, কোনও এক মহিলা তাঁকে বলছেন, ‘আমার পথ ছাড়! আমি যাব।’ কিন্তু, কণ্ঠস্বর শুনলেও তিনি মন্দিরে কাউকেই দেখতে পাননি। এই ঘটায় ওই ব্যক্তি ভয় পেয়ে বাড়ি ফিরে যান। পরদিন মন্দিরে গিয়ে তিনি দেবীর কাছে সিঁড়ি আটকে শুয়ে থাকার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।