হারিয়ে যাওয়া এক টর্নেডো

চোখে চশমা, কপালে হেডব্যান্ড, হাতে রিস্টব্যান্ড। মাঠের নামার আগেই সে কী আগ্রাসন। ড্রেসিংরুমে বলে দিলেন, "ভিভ রিচার্ডসের উইকেটটা আমিই পাব।" করলেনও তাই। উপড়ে গেল ভিভের স্ট্যাম্প। হতভম্ভ ভিভ। এভাবে তাঁকে কেউ আউট করেনি। একবারে বলে কয়ে এসে রিচার্ডসের উইকেট! তাও কোনও পেসার নয় একজন নবাগত লেগ স্পিনার! যার হাত থেকে বেরনো ফ্লিপার ধরতেই পারেননি কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান।

মাদ্রাজের সেই টেস্ট জুড়েই চলেছিল গুগলি, ফ্লিপার, লেগব্রেক-সহ সকল রকম লেগ স্পিন অস্ত্রের প্রদর্শনী। পাঁচ বছর আগে যে কিশোরকে বাতিল করে দিয়েছিলেন নির্বাচকরা সেদিন তিনিই জ্বালিয়ে ছারখার করে দেন রেকর্ড বই! তিনি নরেন্দ্র হিরওয়ানি। কিন্তু ওই স্পিন ঝড় ছিল আজকালকার হঠাৎ উদয় হয়ে মিলিয়ে যাওয়া লোকাল টর্নেডোর মতো।

আশির দশক। ১৪ বছরের এক ছেলে নির্বাচকদের সামনে এসে বলেছিল ‘আমি ভারতের হয়ে খেলবো’, শুনে নির্বাচকরা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন। শৈশবের সেই তাচ্ছিল্যের উত্তর দিয়েছিলেন নরেন্দ্র হিরওয়ানি।

narendrahirwani1

নামটা চট করে অনেকেই চিনতে পারবেন না। ভারতীয় ক্রিকেটের বিস্মৃত এক চরিত্র। উত্থান ঝড়ের মতো, পতন কীভাবে হয়েছিল, কেন হয়েছিল, তার উত্তর তিনি নিজেই দিতে পারবেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে যতটাই ভালো, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ততটাই খেই হারানো। ভারতীয় দলের জন্য দারুণ এক সম্পদ হওয়ার সুযোগ থাকার পরও তিনি সেটা হতে পারেনি। তবে ইতিহাসের পাতা থেকে এখনও তাঁর নাম মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি।

যে কোনও দিন, যে কোনও কন্ডিশনে, যে কোনও দলের বিপক্ষে, যে কোনও প্রেক্ষাপটেই এক টেস্টে ১৬ উইকেট নেওয়া বিরাট ব্যাপার। আর সেটা যদি সেই ১৯৮৮ সালের তখনও ভয়ঙ্কর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে নেওয়া যায় তাহলে তো কথাই নেই। হ্যাঁ, এই কাণ্ডটিই ঘটিয়েছিলেন নরেন্দ্র হিরওয়ানি। লেগ স্পিনারের সেটাই অভিষেক টেস্ট। ১৩৬ রান দিয়ে তিনি ১৬ উইকেট নেন। প্রতি ইনিংসে নিয়েছিলেন আটটি করে উইকেট।

ভারত ম্যাচ জিতেছিল ২৫৫ রানের বিরাট ব্যবধানে। জয় খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এর আগে টানা নয় বছর ক্যারিবিয়ানরা অপরাজিত ছিল ভারতের বিপক্ষে। আজও অভিষেকে যে কোনও বোলারের সেরা বোলিং ফিগার এটাই। হিরওয়ানির বয়স তখন মাত্র ১৯। ক্যারিয়ারের প্রথম চার টেস্টেই নেন ৩৬ ‍উইকেট। সেখান থেকে তাঁর ক্যারিয়ারের গ্রাফ যেমন হওয়া উচিৎ ছিল, তেমন হয়নি।

narendrahirwani2

পরের ন'টি টেস্ট খেলেন দেশের বাইরে। তাতে ৫৯ গড়ে পান ২১ ‍উইকেট। তখন থেকেই দলে আসা যাওয়া শুরু হয়। ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ দলে জায়গা পাননি। সর্বশেষ জাতীয় দলে খেলেন ১৯৯৬ সালে। ১৭ টেস্টে ৬৬ উইকেট আর ১৮ ওয়ানডেতে ২৩ উইকেটেই ইতি ঘটে তাঁর আন্তর্জাতিক কেরিয়ারের। তারপর গোঁফওয়ালা, চোখে চশমা পরা অনিল কুম্বলে নামের আরেক লেগ স্পিনারের উত্থান আরও সহজ করে তাঁর পতনের রাস্তা। ২০০১ সালে ঐতিহাসিক অস্ট্রেলিয়া সিরিজে স্কোয়াডে ডাক পেলেও একাদশে জায়গা হয়নি।


ঘরোয়া ক্রিকেট অবশ্য খেলেছেন ২০০৫-০৬ সাল পর্যন্ত। আর সেখানে তিনি কিংবদন্তি ছিলেন। ১৬৭ টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলে নিয়েছেন ৭৩২ টি উইকেট। এর মধ্যে মধ্যপ্রদেশের হয়ে রঞ্জি ট্রফিতে পেয়েছেন ৪০০’র বেশি উইকেট।

২৩ বছরের লম্বা ক্যারিয়ার শেষ করে ক্রিকেটের সঙ্গেই ছিলেন। ২০০৮ সালে বিসিসিআই-এর জাতীয় নির্বাচক হন। মধ্যপ্রদেশের রঞ্জি ট্রফির টুর্নামেন্ট সিলেকশন কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন ২০১৪ সালে। ন্যাশনাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমির স্পিন কোচ ছিলেন। ভারতের মেয়েদের দলের সঙ্গেও কাজ করেছেন। তবে, এত কিছুও তাঁর ক্যারিয়ারের আক্ষেপকে মুছে ফেলতে পারেনি।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...