অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ছবি দেখে নন্দলাল বসু যৌবনে এমন মুগ্ধ হন যে, মনে মনে তাঁকেই গুরুপদে বরণ করে নেন। একলব্য হয়ে চর্চা চালিয়ে যাওয়া তাঁর স্বপ্ন ছিল না। তাই গুরুপদে হাজির হয়ে সাক্ষাৎ শিক্ষা নেবার তাগিদ প্রবল হয়ে উঠল। এখন উপায়?
নন্দলালের পিসতুতো দাদা অতুল মিত্র গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলের ছাত্র। তাঁর কাছেই জানতে পারলেন যে, অবনীন্দ্রনাথ এই স্কুলের উপাধ্যক্ষ। ব্যস, নিজের আঁকা কিছু ছবি নিয়ে সোজা স্কুলে গিয়েই দেখা করলেন অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে। তাঁকে প্রণাম করে জানালেন নিজের বাসনার কথা। দেখতে দিলেন, সঙ্গের ছবিগুলো। কিন্তু অবনীন্দ্র সে-সবে মতামত দেওয়ার বদলে নন্দলালকে সিদ্ধিদাতা গণেশের মূর্তির সামনে বসাতে বললেন। তারপর বিরাট মাপের একখানা আর্ট পেপার দিয়ে দেখে দেখে গণেশ মূর্তি আঁকাতে বললেন। সেটাই হবে তাঁর পরীক্ষা। পরীক্ষা নেওয়ার জন্য তাঁকে বসানো হল বটে। অতবড় আর্ট পেপারও তাঁকে দেওয়া হল। কিন্তু মূর্তিটা কত বড় করে আঁকতে হবে সেটা কেউ বলল না। বুদ্ধিমান নন্দলাল এই ফাঁকটুকুকেই কাজে লাগালেন। বড় ছবি আঁকতে গেলে সময় লাগবে, পরীক্ষা দিতে বসে অত সময় তো নেওয়া যাবে না, পাওয়াও যাবে না; তাই তিনি আর্ট পেপারের কোনায় ছোট্ট করে অত্যন্ত সুনিপুণভাবে অল্প সময়ের মধ্যেই ছবিটি এঁকে ফেললেন। অবনীন্দ্রনাথ ছাত্রের উপস্থিত বুদ্ধিতে খুশি তো হলেনই, সেই সঙ্গে হাতের সম্ভাবনাময় নৈপুণ্যে মুগ্ধ হলেন। এবং তারপরই ইন্ডিয়ান পেইন্টিং ক্লাসে ভর্তি করে নিলেন। ক্রমে এই স্কুলেই অবনীন্দ্রনাথের প্রিয় ছাত্র হয়ে তাঁর পদতলে শিক্ষা নিতে নিতে পাঁচ-পাঁচটি বছর কেটে গেল নন্দলালের। স্নেহ পেলেন অফুরন্ত। হয়ে উঠতে লাগলেন দক্ষ থেকে দক্ষতম।
গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুল, ইংরেজ সরকারের দাক্ষিণ্যে চলে। উচ্চ পদে ইংরেজ-শিল্পীরা। সেখানে উপাধ্যক্ষ হিসেবে অবনীন্দ্রনাথ তাঁদের নীচে কাজ করলেও কাউকে পরোয়া করেন না, তোয়াক্কাও করেন না। তিনি কলকাতার অভিজাত, ঠাকুরবাড়ির সন্তান, দেবেন্দ্রনাথের নাতি; বংশের মর্যাদা কখনই ভূলুণ্ঠিত হতে দেন না। স্বজাতীয়ের মর্যাদাও। চলেন রাজার মতোই। স্কুলে অবনীন্দ্রনাথের দিবানিদ্রার বিছানা এবং সবসময় ধূমপানের অভ্যাসের জন্য গড়গড়া প্রস্তুত। ক্লাসে কখনোই খাতা ধরে নাম ডাকেন না। তিনি মনে করেন যে, ক্লাসটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে শিক্ষা নেওয়ার জায়গা; হাজিরার অঙ্ক কষার নয়। পূর্বতন অধ্যক্ষ তাঁর এই খেয়ালগুলোকে শিল্পীসুলভ শ্রদ্ধায় মেনে নিয়েছিলেন বলেই অবনীন্দ্রনাথ স্কুলের কাজে যোগ দিয়েছিলেন।কিন্তু নতুন অধ্যক্ষের আগমনের পর এইগুলো নিয়েই শুরু হল তাঁর সাথে সংঘাত। কিছুতেই না-পেরে নতুন অধ্যক্ষ শেষে অবনীন্দ্রনাথকে জব্দ করতে তাঁর অসুস্থতাজনিত ছুটির আবেদন নাকচ করে দিলেন। আর তাতেই ক্ষুব্ধ হয়ে এক কথায় চাকরি ছেড়ে সেই ইংরেজসন্তানের মুখে ঝামা ঘষে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে এলেন অবনীন্দ্রনাথ।
শুধু শিল্পশিক্ষা নয়, গুরুর কাছে মাথা উঁচু রাখার শিক্ষাও পেয়েছিলেন নন্দলাল। তাই গুরু ও শিষ্যের পথ আলাদা হল না। ফলে গুরুর সাথে সাথে নন্দলালও কয়েকজন সতীর্থের সঙ্গে স্কুল ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। ঠিক করলেন যে, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কাছাকাছি বাড়ি ভাড়া নিয়ে থেকে গুরুর কাছে চিত্রশিক্ষা চালিয়ে যাবেন। স্কুল ছাড়ার সময় যে ইংরেজ-অধ্যক্ষের সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথের বিবাদ, তিনি নন্দলালকে আর্ট স্কুলে চাকরি দিতে চাইলেন; কিন্তু সেই সুযোগ গুরুর মতোই অবলীলায় প্রত্যাখ্যান করলেন নন্দলাল। শিষ্য নন্দলালের গুরুসান্নিধ্য সাধের কথা অবনীন্দ্রনাথ ভালোভাবেই জানতেন। তাই নিজের স্টুডিওতে সহকারীর প্রয়োজন হতেই তিনি নন্দলালকে ডেকে নিলেন। গুরুর অমন সান্নিধ্য পেয়ে নন্দলালের আনন্দের আর সীমা রইল না।
গুরুর সাহচর্যে নন্দলাল এই সময় দেশ-বিদেশের গুণী চিত্রকরদের সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচিত হয়ে সমৃদ্ধ হবার সুযোগ যেমন পেলেন, তেমনি প্রাচীন ভারতীয় চিত্রকলাকে আত্তীকরণ করে স্বদেশিয়ানার পথ ধরে নিজস্ব শৈলীও খুঁজে নিলেন। ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট-এর চিত্রপ্রদর্শনীতে জিতে নিলেন পাঁচশো টাকার পুরস্কার। সময়টা ১৯০৬-৭ সাল।
অবনীন্দ্রনাথের স্নেহশিক্ষা থেকে নন্দলাল আজীবন বঞ্চিত হননি। পরিণত বয়সে নন্দলাল যখন কলাভবনের শিক্ষক, যখন তিনি ধ্যানরত, বিষপানরত, নটরাজ শিবের ছবি এঁকে রীতিমতো বিখ্যাত; ‘প্রবাসী’র পাতায় পাতায় যখন তাঁর ছবি একের পর এক ছাপা হচ্ছে; তখনও নিজের আঁকা বিশেষ ছবি অবনীন্দ্রনাথকে না-দেখিয়ে, তাঁর অনুমোদন না-পেয়ে শান্তি পেতেন না। এমনই ছিল তাঁদের গুরুশিষ্যের আন্তরিক সম্পর্ক যে, ভুল করলে যুবা ছাত্রটির মতো নন্দলালকে বকাবকি করতে অবনীন্দ্রনাথও কসুর করতেন না। এমনই একটি ঘটনার কথা এবার বলি:
‘উমার প্রত্যাখ্যান’ ছবিটি বেশ কিছুদিন ধরে এঁকে নন্দলাল বড় আশা নিয়ে অবনীন্দ্রনাথের কাছে গেলেন একদিন। ছবি দেখে অনেকেই বলেছিলেন, ‘অপূর্ব!’; কিন্তু অবনীন্দ্রনাথ বললেন, ‘কিস্যু হয়নি’। শুনে বড্ড মুষড়ে পড়েছিলেন নন্দলাল।
সেই মনমরা ভাব নিয়ে পথ চলতে চলতেই তিনি একদিন পথের পাশে হঠাৎ প্রত্যক্ষ করলেন একটি প্রেম-প্রত্যখ্যানের ঘটনা—যেখানে অপমানে অবনমিত হল মেয়েটির মাথা। দেখা গেল, বাঁকা গ্রীবার করুণ অভিব্যক্তি। নন্দলাল এবার বুঝলেন, কেন গুরুদেব বলেছিলেন, ছবিটা ‘কিস্যু হয়নি!’। তাঁর ছবিতে বঙ্কিম গ্রীবার এই অভিব্যক্তিটাই যে অনুপস্থিত!
অবনীন্দ্রনাথের সাহচর্যে নন্দলাল শুধু যে গুণী শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন তা-ই নয়; অর্জন করেছিলেন পিতৃসুলভ শিক্ষকহৃদয়। গুরুর মতো তিনিও তাঁর ছাত্রদের সন্তানের মতোই ভালবাসতেন। ছাত্রেরা দূরে কোথাও গেলে চিঠিপত্রে নিয়মিত খোঁজখবর নিতেন। অবনীন্দ্রনাথের উত্তরসূরি হয়ে নিজস্বতা নিয়েও নন্দলাল এগিয়ে নিয়ে চলেছিলেন এক অনন্য গুরুশিষ্য পরম্পরা; যে পরম্পরায় একদা সমৃদ্ধ হয়েছিল বাঙালি তথা ভারতের স্বদেশচেতনা…
তথ্যঋণঃ ‘শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু’ প্রবন্ধ ধীরেন্দ্রকৃষ্ণ বর্মণ।