অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে বাতিল করেছিলেন। প্রথম ছবি দেখে তাঁর মনে হয়েছিল সেই ছবিতে ‘জ্যাঠামি’ মিশেছিল। তাই ছবি তাঁর হবে না।
প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরে গেলেন না। পরের দিন আবার এলেন। অন্য ছবি নিয়ে। এবার খুশি হলেন অবন ঠাকুর। আগামী পাঁচ বছর অবন ঠাকুরের কাছেই তিনি নাড়া বাঁধলেন। ছাত্রের নাম শ্রী নন্দলাল বসু। পরবর্তী সময়ে যিনি ‘শিল্পাচার্য’। শান্তিনিকেতন তাঁকে চিনত ‘মাস্টারমশাই’ নামে।
নন্দলাল বসুর জীবনে দুই ঠাকুরের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের ছোঁয়ায় আমূল বদলে গিয়েছিল তাঁর জীবন। দ্বারভাঙ্গার রোগা কালো ছেলেটার ভুবন দেখার চোখ রং চিনতে শিখেছিল।
তাঁর পঞ্চাশ বছরের জন্মদিনে কবি তাঁর জন্য স্নেহবচনে লিখেছিলেন,
নন্দনের কুঞ্জতলে রঞ্জনার ধারা,
জন্ম-আগে তাহার জলে তোমার স্নান সারা।
অঞ্জন সে কী মধুরাতে
লাগালো কে যে নয়নপাতে,
সৃষ্টি-করা দৃষ্টি তাই পেয়েছে আঁখিতারা।
এনেছে তব জন্মডালা অজর ফুলরাজি,
রূপের-লীলালিখন-ভরা পারিজাতের সাজি।
অপ্সরীর নৃত্যগুলি
তুলির মুখে এনেছ তুলি,
রেখার বাঁশি লেখার তব উঠিল সুরে বাজি।
জোড়াসাঁকোর লালবাড়িতে ‘বিচিত্রা’ সভাগৃহ স্থাপন করেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১৬ সালে নন্দলাল বিচিত্রায় এসে যোগ দেন। তার আগে অবশ্য একবার শান্তিনিকেতন গিয়েছিলেন। সালটা ১৯১৪। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ‘চয়নিকা’র সূত্রে। আরও পরে কবিগুরুর ডাকে কলাভবনে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু শান্তিনিকেতনে যাওয়ার জন্য সহজে মেলেনি গুরুর আজ্ঞা। শেষ পর্যন্ত রবি’কার বিশেষ অনুরোধে ছাত্রকে ছাড়তে রাজী হয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। ১৯১৯-এ কলাভবন শুরু হলে নন্দলাল কলকাতা থেকে এসে যোগ দেন। তবে আবার ফিরেও যান ফিরে আসেন ১৯২০তে। দু’বছর পর কলাভবনের অধ্যক্ষ।
তাঁর আঁকিয়ে হওয়ার কথা ছিল না। আর্ট কলেজে ভর্তি হতে গিয়েছিলেন ‘ভাস্কর’ হওয়ার বাসনা নিয়ে। কিন্তু হলেন চিত্রকর। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁর ক্লাসে ছাত্র হিসেবে ভর্তি হতে চেয়েছিলেন। একবার বলেছিলেন, “আমি কি আর ছবি আঁকি। শুধু আঁচড়-মাচড় কাটি। নন্দলাল তো আমাকে শেখালেনা; কত বললুম। ও হেসে চুপ করে থাকে।”
তাঁর প্রথম পাঠ শুরু হয়েছিল হরিনারায়ণ বসু এবং ঈশ্বরীপ্রসাদের কাছে। পরে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ভার নেন।
নন্দলাল বসুর জীবন একধারায় বয়ে যায়নি। সময়ের নানা প্রভাব প্রভাবিত করেছিল জীবনকে।
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে পোস্টার আঁকতেন রাত জেগে। এসেছিলেন ভগিনী নিবেদিতার সংস্পর্শে। তাঁরই আগ্রহে তিনি দেওয়াল চিত্র সামনে থেকে দেখতে অজন্তায় গিয়েছিলেন। এই দেখা তাঁর পরবর্তী শিল্পজীবনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল।
রবীন্দ্রনাথের লেখার সঙ্গে তাঁর ছবি মিলিয়ে হল সহজপাঠ। হলুদ পাতায় সাদামাটা ছাপা, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থভাগ অলঙ্করণ করেছিলেন তিনি। কাজগুলো ছিল কাগজে ব্রাশ ও কালিতে।
ভারতীয় সংবিধান অলঙ্করণ করেন। তিনি তখন কলাভবনের অধ্যক্ষ। কলাভবন থেকে বারজন সেরা ছাত্রকে বাছাই করা হয়েছিল। বাঙালি ছাড়াও বিভিন্ন প্রদেশের ছাত্ররা ছিল সেই দলে। প্রায় দু’শো ছবি আঁকা হয়েছিল তাঁর মধ্যে থেকে বেছে নেওয়া হয় কুড়িটি।
আলপনা, পদ্ম কুঁড়ি, পদ্মপাতা, পদ্মে। বহুধা সংস্কৃতির বৈচিত্র্যকে ধরে ছিলেন। মহেঞ্জদারো সভ্যতা থেকে শুরু করে আজাদ হিন্দ বাহিনী সব কিছুকে ধরে ছিলেন সংবিধানের পাতায় পাতায়।
প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর অনুরোধে ভারতরত্ন, পদ্মভূষণ, পদ্মশ্রী সহ বিভিন্ন পুরস্কারের স্কেচ তৈরি করেন। ভারতরত্নের নকশা তাঁরই সৃষ্টি।
হরিপুরা কংগ্রেসের দেওয়াল লিপি তাঁর আর এক অন্যন্য কীর্তি। ছোট থেকে গান্ধীবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর অনুরোধে হরিপুরা কংগেস প্যাভেলিয়ন তিনি সাজিয়েছিলেন শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রার ছবিতে। ১৯৩৭ সালে অনুষ্ঠিত হরিপুরা সম্মেলনে তিনি লোকচিত্রের ধারাবাহী ৮৩টি পট প্রদর্শন করেন যা হরিপুরা পট নামে খ্যাত।
শিল্পের মাধ্যমে স্বদেশিয়ানাকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। তাই রাজপুত এবং মোঘল ঘরানা গ্রহণ করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নন্দলাল বসুর সমস্ত ছবি জাতীয় সম্পদ হিসেবে ঘোষনা করেন। তাঁর মাস্টারমশাইয়ের সম্পর্কে বলেছিলেন ‘নন্দলাল বসু ছিলেন একজন যথার্থ আচার্য ।'
নন্দলাল বসুর ছাত্ররা বিনোদবিহারী, রামকিঙ্কর বেইজ, রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শঙ্খ চৌধুরি, কে জি সুব্রহ্মনিয়াম, চিন্তামণি কর প্রমুখ। প্রকৃতিকে দেখার শিক্ষা দিতেন। সেই দেখায় শ্রদ্ধা না মিশলে শিল্পের জন্ম হয় না। ভারতীয় চিত্রশিল্প সম্পূর্ণ অন্য এক দিশা দেখিয়েছিলেন তিনি।