নকশি কাঁথায় উঠে আসত গ্রাম বাংলার লোকায়ত জীবন

নকশি কাঁথা। সময়ের স্রোতে প্রায় হারিয়ে যেতে বসা বাংলার সুপ্রাচীন সূচিশিল্প। মহাভারতেও কাঁথা’র উল্লেখ পাওয়া যায়। গল্পে,উপন্যাসে,কাব্যে, গানে বারবার এসেছে নকশি কাঁথার উপাখ্যান।  নকশি কাঁথায় কারুশিল্পের ক্যানভাসে বলা হত জীবনের গল্প।

নকশি কাঁথায় গ্রাম বাংলার লোকায়ত জীবন, তাদের বেঁচে থাকার গল্প উঠে আসে। নকশি কাঁথায় লুকিয়ে থাকে সমাজের ইতিহাস। সব শ্রেনীর মহিলারা কাঁথা তৈরি করতেন। শিল্পের চোখে দেখা হত। যেখানে ধনী দরিদ্র বিভেদ হত না।

 এপার বাংলা এবং ওপার বাংলা দুই বাংলাতেই কাঁথার প্রচলন ছিল। বাংলাদেশের যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, সিলেট পশ্চিমবঙ্গে বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, বাঁকুড়া, উত্তর- দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় কাঁথা শিল্পের চর্চা হয়। ভারতের আসাম, বিহার, উড়িশাতেও নকশি কাঁথার ব্যবহার দেখা যায়।

FotoJet - 2019-08-30T193758.584

তবে কাঁথা মাত্রই নকশি কাঁথা নয়। সাধারন কাঁথাও দেখা যায়। ৩-৭ টি কাপড় একসঙ্গে জুড়ে সেলাই করা হয়।

কাঁথার নকশায় ধর্মীয় অনুসঙ্গ দেখা যায়। হিন্দু, ইসলাম, বৌদ্ধ ধর্ম চিহ্নের ব্যবহার দেখা যেত। আলপনায় যে ধরনের চিহ্ন ব্যবহার হত তা অনেকটাই রূপ বদলে কাঁথায় ধরা দিত।  লতাপাতা, গাছ, পদ্ম, ফিগার মোটিভ এসব উঠে আসত।

নকশা তোলার জন্য নীল, লাল, সবুজ, কালো সুতোর ব্যবহার বেশি দেখা যায়। অনেক ছেঁড়া শাড়ির পাড় বা শাড়ির সুতোও ব্যবহার করা হত কাঁথার কাজে। কলমিলতা, শঙ্খলতা, মটরলতা, গোলাপ বাগ, এমন একাধিক নাম আছে কাঁথায় ব্যবহৃত নকশার। সেলাই-এর ধরনও অঞ্চলভেদে যেমন নকশী কাঁথা, বাঁশপাতা ফোঁড়, বরকা ফোঁড়, কইতা, তেজবি ফোঁড় ও বিছা ফোঁড় ইত্যাদি নামে পরিচিত।  

FotoJet - 2019-08-30T193857.042

 বাচ্চার কোমরে  বেঁধে দিতে  ত্রিকোণাকৃতি একরকম কাঁথা তৈরি করা হত। একে বলা হত ‘সুতনি’।  বড় আকারের চাদরের মতো কাঁথার নাম ‘সুজনি কাঁথা’। বাড়ির অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হত।  আগেকার দিনে আয়না নিয়ে নানারকম  সংস্কার ছিল।  তাই আয়না ঢেকে রাখা হত। আয়না ঢেকে রাখতে কাঁথা ব্যবহারের চল ছিল।  এই ধরনের কাঁথাকে বলা হত আরশিলতা কাঁথা ।  FotoJet - 2019-08-30T193829.186

ব্যবহার অনুযায়ী বদলে যেত কাঁথার নাম। যেমন-শীতের জন্য লেপকাঁথা, বালিশে ব্যবহারের জন্য বর্তন, বসার জন্য আসনকাঁথা, খাবারের জন্য ব্যবহৃত দস্তরখান বা বর্তন কাঁথা , নামাজের জন্য জায়নামাজ কাঁথা ইত্যাদি। ।

এমনকি মৃতদেহ ঢাকতেও  কাঁথা ব্যবহার করা হত। তাকে বলা হত মরণকাঁথা। এই কাঁথায় কোনও গিঁট থাকত না।

গ্রামের মহিলারাই আদতে কাঁথার শিল্পী। সাধু, পির, ফকির এঁদের কাঁথা দান করলে মঙ্গল হয় পরিবারের। কাঁথা শিল্প গড়ে ওঠার পশ্চাতে ধর্ম অন্যতম কারণ। কিন্তু সেখানেও সহজ সম্প্রীতির আবহ ছিল। বাউল-ফকিররা ছেঁড়া কাপড় জুড়ে জুড়ে সেলাই করে কাঁথা বুনে ব্যবহার করতেন।  

বাড়িতে নবজাতক এলে বিয়ে বা বাড়িতে বিশেষ অতিথি এলে তাঁকে কশি কাঁথা দিয়ে বরণ করা হত।

মানুষের জীবনে ব্যস্ততা যত বেড়েছে তত সময় কমেছে। অবসর কমেছে জীবন থেকে। বদলে যাওয়া সমাজ কাঠামোয় ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ছে লোকায়ত শিল্প।  সেভাবেই কাঁথাও আজ অবলুপ্তির পথে। শাড়ি, ব্যাগ, আর ঘর সাজাবার উপকরণ হিসেবে ‘কাঁথা কাজ’ বেঁচে আছে। কিন্তু নকশি কাঁথার সামাজিক  গুরুত্ব  আজ কোণঠাসা।

গুরুসদয় দত্ত বাংলাদেশ থেকে কাঁথা সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁর সেই সংগ্রহ গুরুসদয় দত্ত মিউজিয়ামে সংরক্ষিত হচ্ছে।

 ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল, বিশ্বভারতীর  রবীন্দ্রভবনে , বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ মিউজিয়াম, ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম, আকাদেমি অব ফাইন আর্টস-  পশ্চিম বঙ্গের এই সমস্ত মিউজিয়াম এবং সংরক্ষণ কেন্দ্রগুলিতে পুরনো কাঁথা সংরক্ষণ করা হয়েছে। আগ্রহী দর্শকদের দেখার সুযোগও রয়েছে।    

  

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...