কালী কথা: শ্যামাসুন্দরী কালী, সিদ্ধতন্ত্র মতে পূজিতা তিনশো বছরের দেবী কালিকা

আজকের কালী কথায়, আবার কলকাতা ছেড়ে শহরতলীতে পাড়ি। গঙ্গা তীরের নৈহাটিতে বিরাজ করেন বড়মা, তিনি ছাড়াও এই এলাকায় রয়েছেন আরেকজন দেবী কালিকা। তাঁর নাম শ্যামাসুন্দরী, শ্যামাসুন্দরী মন্দিরের শ্যামাসুন্দরী কালিকা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য নজির উত্তর ২৪ পরগনার এই মন্দির। বয়সে মন্দিরটি প্রায় ৩০০ বছরেরও বেশি পুরনো। এই কালী মন্দিরের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সুবে বাংলার ইতিহাস। বাংলা, বিহার, ওড়িশার অর্থাৎ সুবে বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁও জড়িয়ে আছেন মন্দিরের সঙ্গে।

56211ce3-8bf9-444b-a1e4-7bae5338394d

জানা যায়, আনুমানিক ১৬৭৫–৭৭ সাল নাগাদ বর্ধমান জেলার আমাদপুর গ্রামের বাসিন্দা জনৈক তান্ত্রিক রামানন্দ ব্রহ্মচারী, তন্ত্রসাধক তাঁর ছেলে সদানন্দের সঙ্গে নৈহাটির গঙ্গা তীরবর্তী এক জায়গায় চলে গিয়েছিলেন। সেখানেই একটি গাছের তলায় তন্ত্রসাধক বাবা–ছেলে বসবাস করতেন। হঠাৎ করেই একদিন তাঁদের সঙ্গে এক সন্ন্যাসীর পরিচয় হয়। সেই সন্ন্যাসী রামানন্দ ব্রহ্মচারীকে ‘সিদ্ধমন্ত্র’ দান করেন। কিছুকাল পর, চলে যাওয়ার সময় সন্ন্যাসী সেই সিদ্ধমন্ত্র ফেরত চেয়েছিলেন। কিন্তু সিদ্ধমন্ত্র ফিরিয়ে দিতে পারেননি রামানন্দ। তিনি সন্ন্যাসীকে শাস্ত্র বিষয়ে তর্কে আহ্বান করেন। শাস্ত্র বিষয়ক তর্কে হেরে গিয়ে সন্ন্যাসী নিজের ঝুলি থেকে একটি মাটির ঘট ফেলে দিয়ে বলেন, ‘‌যা বেটি যা! দেখছি ব্রাহ্মণের ভাত খেতে তোর বড় সাধ হয়েছে!’‌ তারপরই সন্ন্যাসী সেখান থেকে চলে যান। সন্ন্যাসী চলে যেতেই রামানন্দ সেই ঘট স্থাপন করেন। গুরু এবং ইষ্টের এক রূপ হিসেবে, কৃষ্ণ বা শ্যাম এবং কালী বা শ্যামার রূপ কল্পনা করেছিলেন রামানন্দ। তাই এখানে দেবীর নাম শ্যামাসুন্দরী। মন্দিরের নাম শ্যামসুন্দরী মন্দির, জায়গার নাম হয় শ্যামসুন্দরী তলা।

মন্দিরের ইতিহাস বলে, দেবী কালিকার দৈব দেবী-ঘট প্রতিষ্ঠা হয়েছিল অনুমানিক ১৭২০ সালে থেকে ১৭২১ সালের মধ্যে, রামানন্দ ব্রহ্মচারী ওরফে দেবীর ঘট ও পঞ্চমুণ্ড আসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দেবী কালিকার প্রস্তর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কালী প্রসাদ ভট্টাচার্য। তিনি রামানন্দের ষষ্ঠ পুরুষ। অনুমানিক ১৮২০-১৮২৫ সালের মধ্যে দেবী কালিকার মূর্তি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।

শোনা যায়, রামানন্দের কোনও অলৌকিক কাজে মুগ্ধ হয়ে তৎকালীন বাংলা–বিহার–ওড়িশার নবাব আলিবর্দি খাঁ, শ্যামাসুন্দরীর মন্দিরের জন্য নিষ্কর জমি দান করেছিলেন। অর্থাৎ নবাবের দেওয়া জমিতেই গড়ে উঠেছিল দেবী কালিকার মন্দির। তারপর প্রায় ১০০ বছর যাবৎ মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত রামানন্দের ওই মাটির ঘটেই পুজো চলেছিল। তারপর রামানন্দের ষষ্ঠ পুরুষ কালীপ্রসাদ ভট্টাচার্য ৪২ কেজি ওজনের কষ্টিপাথরের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। সেই ঘট এবং বিগ্রহ, আজও নৈহাটিতে পূজিত হচ্ছে।

এই মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন কাজী নজরুল ইসলাম। জনশ্রুতি রয়েছে, এই মন্দিরের পাশেই নজরুল ইসলামের বন্ধু খগেন ঘোষের বাড়ি ছিল। সেখানে এলেই, বিদ্রোহী কবি মন্দিরে যেতেন। স্বরচিত শ্যামাসঙ্গীত বসে বসে গেয়ে শোনাতেন দেবী কালিকাকে। লোকমুখে শোনা যায়, এই মন্দির চত্বরে বসেই কবি নাকি প্রচুর শ্যামাসংগীত লিখেছিলেন। কালী সাধক, কালী মন্দির ইত্যাদির সঙ্গে সুর ওতপ্রোতভাবে মিশে গিয়েছে। রামকৃষ্ণ থেকে রামপ্রসাদ সকলেই আরাধ্যা দেবীকে গান শোনাতেন। অ্যান্টনি কবিয়ালও কালিকাকে গান শোনাতেন।

রামানন্দের বর্তমান বর্তমান বংশধররা আজও এই মন্দির দেখভাল করেন, তাঁরাই মন্দিরের সেবাইত। মন্দিরের কোনও ট্রাস্টি বোর্ড নেই। আজও শ্যামসুন্দরী মন্দির আদ্যন্ত পারিবারিক মন্দির। দেবীর ভক্ত সংখ্যা তা বলে কম। অসংখ্য ভক্ত ভিড় করেন মন্দিরে, দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ-জন আসেন। কার্তিক অমাবস্যায় অর্থাৎ কালী পুজোর দিন সারারাত ধরে পুজো হয় মন্দিরে। একসময় এই মন্দিরে বলি প্রচলিত ছিল কিন্তু বিগত প্রায় ৮০ বছর ধরে বলিদান বন্ধ হয়ে গিয়েছে। যদিও পুজোর সময় প্রতীকী আখ বা চালকুমড়ো বলি দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। কালীপুজোর অন্যতম উপকরণ হল কারণবারি, কিন্তু এই মন্দিরে দেবী কালিকাকে কারণ নিবেদন করা হয় না। বদলে শ্যামাসুন্দরীকে কাঁসার গ্লাসে ডাবের জল দেওয়া হয়। আজ ভক্ত থেকে শুরু করে স্থানীয় মানুষ-জন দেবীকে জাগ্রত মনে করেন। মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য দেবীর পুজো করেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...