সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শহর নৈহাটি, সেখানকার বড়মাই আজকে আমাদের কালীকথায় আলোচ্য। নৈহাটির শ্যামাপুজোর অন্যতম প্রধান আকর্ষণ অরবিন্দ রোডের বড় কালী, অর্থাৎ বড়মার পুজো। প্রায় নয় দশক অতিক্রম করে ফেলেছে পুজোর বয়স। মাতৃ প্রতিমাতই এই পুজোর বিশেষত্ব, নৈহাটির বড়মার প্রতিমা উচ্চতায় ২১ ফুট। ঘন কৃষ্ণবর্ণ প্রতিমা স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিতা। এখানে কোজাগরী পূর্ণিমার সন্ধ্যায় বড়কালীর কাঠামো পুজো হয়। তারপর সেই কাঠামোতেই মায়ের মূর্তি গড়ার কাজ শুরু হয়। গঙ্গায় যাওয়ার রাস্তাতেই চলে মাতৃ প্রতিমা নির্মাণ। স্থানীয়দের বিশ্বাস, নৈহাটির বড়মা খুবই জাগ্রত। ভক্তরা মায়ের কাছে কোন কিছু চাইলেই মা ভক্তদের মনস্কামনা পূর্ণ করেন। তাই মায়ের আশীর্বাদ পেয়ে ভক্তরা মুক্ত হস্তে দান করেন। অনেক ভক্তরা মানত করেন ও দন্ডি কাটেন। মনের ইচ্ছাপূরন হলেই ভক্তরা মাকে অলঙ্কার গড়িয়ে দেন।
অরবিন্দ রোডের ধর্মশালা মোড়ে আগেই রক্ষাকালীর পুজো হত। দেবীকে পুজো করে গভীর রাতেই বিসর্জন দেওয়া হত। পরবর্তীকালে সেই পুজো বন্ধ হয়ে যায়। পরে নদিয়া জুটমিলের কর্মী ভবেশ চক্রবর্তী বড়মার পুজোর প্রচলন করলেন। নৈহাটির অন্যান্য কালী প্রতিমার চেয়ে এখানকার মূর্তির উচ্চতা অনেক বেশি। সেকারণেই দেবীর এমন নামকরণে হয়েছে। মা এখানে দক্ষিণা কালী রূপে পূজিত হন। তাই বলি দেওয়া হয় না। ভবেশ চক্রবর্তীর বাড়ি থেকে ভোগ আসে, রীতি মেনে ভোগ এখনও দেওয়া হয়। পুজোর রাতে বড়মার ভোগে থাকে পোলাও, খিচুড়ি, পাঁচ রকমের ভাজা, তরকারি, লুচি, চাটনি,পায়েস। বিসর্জনের আগের দিন রাতে দেবীকে লাড্ডু ভোগ দেওয়ার প্রথাও মানা হয়ে আসছে।
রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তরা নৈহাটিতে বড়মার পুজো দিতে ছুটে আসেন। ভক্তদের বিশ্বাস, মা মনস্কামনা পূর্ণ করেন। মনস্কামনা পূরণ হলেই, ভক্তরা দেবীকে সোনা-রুপোর অলঙ্কারে ভরিয়ে দেন। পুজোর দিন দেবীকে সব অলঙ্কার পরানো হয়। পুজোয় কোন চাঁদা নেওয়া হয় না। আর্থিক সহায়তা ও ভক্তদের অনুদানেই পুজোর আয়োজন হয়ে আসছে। প্রতিবছর দীপান্বিতা অমাবস্যায় সারা রাজ্য থেকে কয়েক লক্ষ ভক্ত সমাগম সেখানে।
নৈহাটি স্টেশন থেকে গঙ্গার ঘাট যাওয়ার পথে, মায়ের মন্দির অবস্থিত। মন্দিরে বড়মা নিত্য পূজিতা হন। কৃষ্ণ বর্ণ, মুক্ত কেশী, ভয়ংকরী চোখ ও অলঙ্কারে মোড়া মাতৃ রূপ বড়মার।
কালী পুজোর সময় দেবীকে ২০০ ভরী রূপো ও ১০০ ভরী সোনার গহনায় সাজানো হয়। মায়ের মুখ মন্ডল ও দেহে মুকুট, চাঁদ মালা, মল রুপোর তৈরি ও জিহ্বা, ত্রিনেত্র, নাক, ভুরু, ও চন্দন আঁকা সোনার তৈরি। টিকলি থেকে শুরু করে দেবীকে রকমারি সোনার গহনায় সাজানো হয়।
পুজোর মূলমন্ত্র, 'ধর্ম হোক যার যার, বড়মা সবার'। বড়মার মন্দিরেও তা লেখা রয়েছে। মায়ের কাছে পুজোর জন্যে যা ফল, কাপড় আসে তা অনাথ আশ্রম, বৃদ্ধাশ্রমেও বিলি করা হয়। কালীপুজোর সময় ৪০০০-৫০০০ কিলোর ভোগ রান্না হয়। বড়মার পুজোর সমস্ত রান্না হয় গাওয়া ঘিতে। কালীপুজো ব্যতিত বছরের বাকি ১১ টা অমাবস্যারর রাতে মায়ের বিশেষ পুজো চলে। পুজোয় পাওয়া শাড়ী দুঃস্থদের মধ্যে বিলি করা হয়। মায়ের বেনারসি শাড়ী গরীব অবিবাহিত মেয়েদের বিয়ের জন্যে দেওয়া হয়। বড়মার কাছে দেওয়া ফল হাসপাতালের মানুষদের মধ্যেও বিতরণ করা হয়।
এই দেবী মূর্তি নিয়েও এক কাহিনী রয়েছে। জনশ্রুতি বলে, জনৈক ভবেশ চক্রবর্তী এবং তাঁর কয়েকজন বন্ধু নবদ্বীপে রাস দেখতে গিয়েছিলেন। সেখানেই রাধাকৃষ্ণের বিশাল প্রতিমা দেখে ভবেশ চক্রবর্তী মনস্থির করেন, তাঁরাও এমন উঁচু মাতৃপ্রতিমা বানিয়ে কালী পুজো শুরু করবেন। এরপরই নৈহাটি ফিরে ২১ ফুট লম্বা কালী প্রতিমা তৈরি করে প্রথমবার পুজো করেন তাঁরা। সেই থেকেই পুজো শুরু হয়। এখানে বৈষ্ণবমতে, দক্ষিণাকালীরূপে দেবী মা পূজিতা হন। প্রতিষ্ঠাতার নামেই মায়ের নাম হয়েছিল 'ভবেশ কালী'৷ উচ্চতা ও অতিকায় আকারের কারণেই পরবর্তীতে কালিকার নাম হয় বড়মা। আজও ভবেশ বাবুর বাড়ি থেকেই পুরনো ঐতিহ্যকে মেনে মায়ের নৈবেদ্য আসে। কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর দিনে কাঠামো পুজোর পর ১৫ দিনের মধ্যে ২১ ফুট মৃন্ময়ী কালী প্রতিমা তৈরি হয়। ভক্তদের দান করা অলঙ্কারে সুসজ্জিতা হন দেবী মূ্র্তি।
কালীপুজোর দিন থেকে পরের চার দিনে দেবীর পুজো হয়। প্রত্যেক দিন আলাদা আলাদা ভোগ নিবেদন করা হয়। নৈহাটিতে সবার প্রথমে বড়মার প্রতিমার বিসর্জন হয়। প্রতিমা বিসর্জনেও রয়েছে অভিনবত্ব। মায়ের ও শিবের চক্ষু ছাড়া অন্য সমস্ত সোনার গয়না খুলে নেওয়া হয়। ফুলের গহনায় মাকে সাজানো হয়। বিশাল প্রতিমাকে ট্রলি করে নিয়েই গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয়। আগুনিত ভক্ত প্রতিমা নিরঞ্জনের সাক্ষী থাকেন।