নবজাগরণের আলোয় উনিশ শতক বাঙালিজীবনে কেবলই প্রাপ্তির শতক। আপন মাতৃভাষাকে অন্তরের ধন করে নেওয়ার শতক। এই শতকেই বিদ্যাসাগর বাঙালিকে দিয়েছিলেন বাংলাভাষার সুষ্ঠু ও সুবিন্যস্ত বর্ণমালার সংকলন; আর নগেন্দ্রনাথ বসু তাঁর জীবনভরের শ্রমে বাংলাভাষাকে দান করেছিলেন বন্দিত ‘বিশ্বকোষ’। যা এখনও বাঙালির গর্ব আর গৌরবের সম্পদ।
আঠের শতকের মাঝামাঝি ইংরেজি ভাষায় সংকলিত হয়েছিল বিশ্বকোষ, ‘এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা’। ছাত্রাবস্থাতেই বাংলাভাষায় তেমনই একটি সংকলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন নগেন্দ্রনাথ। কিন্তু সে যে অনেক অধ্যবসায়, অনেক শ্রম, অনেক দিনের নিষ্ঠার কাজ! তাই স্বপ্ন ছিল পড়াশুনো শেষ করে সেই বিরাট কর্মযজ্ঞে ঝাঁপ দেওয়ার। তাঁর যখন মাত্র বিশ বছর বয়স, তখন অন্যদিকে একই ভাবনা মাথায় নিয়ে বিশ্বকোষ সংকলনের কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন দুই লেখক, রঙ্গলাল মুখোপাধ্যায় ও ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়। ১৮৮৭ সালে তাঁদেরই সম্পাদনায় বাংলাভাষায় ‘বিশ্বকোষ’-এর প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়। আর নগেন্দ্রনাথের পক্ষে অপেক্ষা করা সম্ভব হল না। তিনি মহাউৎসাহে দুই লেখকের সঙ্গে যেচে সাক্ষাৎ করে নিজের কাঁধে তুলে নিলেন পরবর্তী খন্ডগুলির সংকলন ও সম্পাদনার কাজ। রচিত হল ইতিহাস। দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে সম্পূর্ণ করলেন চব্বিশ খণ্ডের মহাগ্রন্থ ‘বিশ্বকোষ’। যা নিজেই প্রকাশ করলেন ১৯১১ সালে।
১৯১১ সাল। বাঙালিজীবনে এক স্মরণীয় বছর। এ-বছর কলকাতা থেকে ইংরেজের রাজধানী দিল্লি চলে গেল; মোহনবাগান খালি পায়ে বুটওয়ালা ইংরেজের বিরুদ্ধে ফুটবল খেলে তাদের হারিয়ে বাঙালিকে গর্বিত করলেন, আর এই বছরেই ‘বিশ্বকোষ’-এর মতো রত্নমালা বাংলা ও বাঙালিকে উপহার দিলেন নগেন্দ্রনাথ।
নগেন্দ্রনাথ নিজে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিচিত্রবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ ও সন্ধানী পাঠক ছিলেন বলেই দীর্ঘ সময় ধরে ‘বিশ্বকোষ’-এর মতো মহাগ্রন্থের সংকলন ও সম্পাদনা তাঁর পক্ষে করা সম্ভব হয়েছিল। তাছাড়া ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর অন্যরকমের একটি টান ছিল, তাতে সৃজনশীলতা ছিল। সেই পথ বেয়ে কৈশোরেই তিনি সাহিত্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। রচনা করেছিলেন ‘পার্শ্বনাথ’, ‘লাউসেন’, ‘হরিরাজ’-এর মতো নাটক। নাটকগুলো মঞ্চস্থ হয়েছিল। অনুবাদ করেছিলেন সেক্সপিয়ারের ‘ম্যাকবেথ’ ও ‘হ্যামলেট’। সেই সঙ্গে ‘তপস্বিনী’ ও ‘ভারত’-এর মতো একাধিক পত্রিকা সম্পাদনার কাজও করেছিলেন। মাত্র আঠের বছর বয়সেই নিযুক্ত হয়েছিলেন ‘শব্দেন্দু মহাকোষ’ নামের অভিধান সংকলনের কাজে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বাংলা বিভাগ’ যাঁদের শ্রমে ও সেবায় গড়ে উঠেছিল, নগেন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। ভাষা ও সাহিত্যের সেবা ছাড়াও পুরাতত্ত্ব এবং ইতিহাসচর্চায় তাঁর অত্যন্ত আগ্রহ ছিল। সেই আগ্রহের রাস্তা ধরেই তিনি বাংলা তো বটেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উদ্ধার করেছেন প্রাচীন পুঁথি, শিলালিপি, তাম্রলিপি এবং অসংখ্য কুলজিপুঁথি। ইতিহাসকারেরা যে কুলজিপুঁথিগুলিকে এতকাল উপেক্ষা করে এসেছিলেন, তিনি তাদেরই অবলম্বনে রচনা করেছিলেন কয়েক খণ্ডে ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’। অপূর্ব তথ্যের সমন্বয়ে তাতে তুলে এনেছিলেন বর্গ, বর্ণ আর কুলের ভেদে দীর্ণ এক প্রবহমান বাঙালিজাতির অচর্চিত অধ্যায়।
নগেন্দ্রনাথ তাঁর পাণ্ডিত্যের জন্য সমসময়ের পণ্ডিতমহলে সমাদৃত তো ছিলেনই; সেই সঙ্গে একদা যুক্ত ছিলেন ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’ ও ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’-এর মতো দুই বিখ্যাত সারস্বতচর্চা কেন্দ্রের সঙ্গেও। সেই সময় তিনি সম্পাদনা করেছেন অনেক প্রাচীন গ্রন্থ; রচনা করেছেন ময়ূরভঞ্জ, ওড়িশা, কামরূপ প্রভৃতি অঞ্চলের পুরাতাত্ত্বিক ইতিহাস। বিচিত্রবিদ্যাচর্চার জন্য পেয়েছেন ‘প্রাচ্যবিদ্যার্ণব’ উপাধি।
নিবেদিতপ্রাণ পণ্ডিত এই মানুষটি আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে ১৮৬৬ সালের ৬ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন কলকাতার বাগবাজারের কাঁটাপুকুর বাই লেনে। যদিও তাঁর পূর্বপুরুষের আদি নিবাস ছিল হুগলির মাহেশে; কিন্তু তাঁর জন্মের বহু আগেই তাঁরা সেখান থেকে উঠে এসে বাগবাজারে বসতি স্থাপন করেন। এখনও বাগবাজারে রয়েছে নগেন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষের সেই বাড়ি, যে বাড়িতে বসেই তিনি রচনা করেছিলেন মহাগ্রন্থ ‘বিশ্বকোষ’। আর তাঁর সেই মহান কীর্তির কথা সর্বদা স্মরণে রাখতে ১৯১৫ সালেই এই বাড়ির সামনের রাস্তাটির নাম দেওয়া হয়েছিল, ‘বিশ্বকোষ লেন’। সেই লেন বেয়েই আপামরের কাছে কীর্তির সঙ্গে সঙ্গে আজ কর্তাও স্মৃত হন। কেননা কথাতেই আছে, ‘কীর্তির্যস্য স জীবতি…’।