আজকের কালী কথায় উঠে আসবে ভবতারিণীর তিন বোনের কথা। শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিনেশ্বরের মা ভবতারিণীকে মা বলে সম্বোধন করতেন। অন্যদিকে অনতিদূরে গঙ্গাতীরের আরেক জনপদ হল বরাহনগর। এই বরাহনগর অঞ্চলের দুই কালীমূর্তিকে মাসী বলে ডাকতেন ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। অর্থাৎ তারা দুজন হলেন মা ভবতারিণীর দুই বোন। তার মধ্যে একজন হলেন কৃপাময়ী কালী আর অন্য জন হলেন ব্রহ্মময়ী কালী। শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব এই তিন মূর্তিকে তিন বোন বলে মনে করতেন। তার নেপথ্য কারণ নিহীত রয়েছে মাতৃমূর্তি নির্মাণের মধ্যে। এই তিনটি মূর্তিই বর্ধমানের দাঁইহাটের বিখ্যাত নবীন ভাস্কর অর্থাৎ নবীন চন্দ্র পালের হাতে তৈরি। তিনটি মূর্তিই কষ্টিপাথরের। এছাড়াও গঠনশৈলীর দিক দিয়ে এই তিনটি মূর্তির মধ্যে অনেক মিলও আছে। তিনটির মধ্যে প্রথম মূর্তিটি প্রতিষ্ঠিত হয় জয় মিত্রের মা কৃপাময়ী কালী মন্দিরে যা কৃপাময়ী কালী মূর্তি। প্রতিষ্ঠার সময় ১৮৫০ সাল, বাংলার ১২৫৭ বঙ্গাব্দ, দ্বিতীয় মূর্তিটি ১৮৫২ সালে বা ১২৫৯ বঙ্গাব্দে প্রামাণিক কালীবাড়িতে মা ব্রহ্মময়ী কালী মূর্তি রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। সবশেষে নবীন বানান দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দিরের ভবতারিণী মায়ের মূর্তি। যা ১৮৫৫ সালে, বাংলার ১২৬২ সন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।
তিনটি মন্দিরই নবরত্ন স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি। যদিও প্রথম দুটি মন্দিরের থেকে দক্ষিণেশ্বরের মন্দির একটু আলাদা। দক্ষিণেশ্বরের মন্দির চিরাচরিত বাংলার নিজস্ব স্থাপত্য রীতি চালা ঘরানাতে তৈরি, আর বাকি দুটি মন্দির দালান রীতিতে তৈরি।
আজ আমরা কৃপাময়ী কালীর কথা বলব। কৃপাময়ী কালী মন্দিরটি জয় মিত্রের কালীবাড়ি নামেই পরিচিত। গঙ্গার পাড়েই এই মন্দির অবস্থিত। গঙ্গার তীর বরাবর এই মন্দিরে পৌঁছে যাওয়া খুব সহজ। এই জয় মিত্রের কালীবাড়িতে শ্রী রামকৃষ্ণদেব অনেকবার এসেছেন।শোনা যায়, মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন শোভাবাজারের বিখ্যাত মিত্র বাড়ির রামচন্দ্র মিত্রের ছেলে জয় মিত্র। রামচন্দ্র মিত্র ছিলেন ধনকুবের, বিদেশী জাহাজের এক লালমুখো সাহেব ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কারবার জমিয়ে বেশ ভাল টাকা আয় করে ফেলেছিলেন। পরবর্তী কালে তার একমাত্র ছেলে জয়নারায়ণ মিত্র নিজের বুদ্ধি ও ক্ষমতাবলে প্রভূত সম্পত্তির মালিক হন। তিনি নানান সামাজিক কাজে প্রচুর অর্থ দান করতেন। শোভাবাজারে জয় মিত্রের বাড়ির দুর্গাপুজো কলকাতার অন্যতম প্রাচীন বনেদি বাড়ির পুজো। সেকালের কলকাতায় বিশাল জাঁকজমকপূর্ণ ভাবেই মিত্র বাড়ির দুর্গাপুজো সম্পন্ন হত। শোভাবাজার অঞ্চলে তার নামে একটি রাস্তাও রয়েছে।
শোনা যায়, শ্যামনগরের মূলাজোড়ের ব্রহ্মময়ী কালীমন্দির দেখেই জয় মিত্র বরাহনগর এই মন্দির গড়ে তুলেছিলেন। জনৈক এক সাহেবের কাছ থেকে গঙ্গার ধারের তিন বিঘা জমি কিনে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। সময়টা ছিল ১৮৫০ সালে, বাংলা ১২৫৭ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংক্রান্তির দিন।
মন্দিরে ঢোকার মুখেই সিংহদুয়ার। দুপাশের স্বল্প উচ্চতা বিশিষ্ট থামের ওপর দুটি সিংহ বসানো আছে। মন্দিরটি দক্ষিণমুখী। নবরত্ন স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত। মন্দিরটির বর্ণ ধবধবে সাদা, যা দূর থেকে নজর কাড়ে। চূড়াগুলি কালচে খয়েরী রঙের। ত্রিখিলানযুক্ত উঁচু ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত হলেও, এই মন্দিরের ছাদ চালা রীতির নয়। দালান রীতির। সমতল ছাদের চার কোণায় চারটি পীরারীতির চূড়া বা রত্ন রয়েছে। তারপরের ছোট নীচু দালানের ছাদের চারকোণায় আবার চারটি চূড়া বা রত্ন। এবং একদম শীর্ষে একটু উঁচু চূড়া রয়েছে। মোট নটি চূড়া। মন্দিরটির ওপরে রয়েছে পঙ্খের কাজ। খিলানের ধারেও রয়েছে সুন্দর নকশা। থামগুলো কলাগেছ্যা রীতিতে তৈরি। মন্দিরের সামনে রয়েছে বিশাল নাটমন্দির। মন্দিরের সিঁড়ি, মেঝে, নাটমন্দিরের মেঝে সব মার্বেল পাথর নির্মিত। মন্দিরের ত্রিখিলানের পর টানা অলিন্দ তারপর গর্ভগৃহ। গর্ভগৃহের মাঝে একটিই দরজা। যদিও এখানেও এক অভিনবত্ব দেখা যায়। দুপাশের দেওয়ালে দুটি নকল দরজার নকশা আছে। এছাড়াও মন্দিরের তিন দিকেও তিনটি নকল দরজার নকশা আছে।
এখানেও কালীর সঙ্গে শিবের সহাবস্থান। মন্দির চত্বরে রয়েছে আটচালা বিশিষ্ট শিব মন্দির। দুপাশে ছয়টি করে মোট বারোটি শিব মন্দির। প্রতিটি মন্দিরের একটি করে নাম আছে। কালী মন্দিরের বামদিকের শিব মন্দিরগুলির নাম যথাক্রমে পশুপতিনাথ, বিশ্বনাথ, বৈদ্যনাথ, চন্দ্রনাথ, অমরনাথ এবং ভুবনেশ্বর। কালী মন্দিরের ডানদিকের শিব মন্দিরগুলোর নাম হলো যথাক্রমে রামেশ্বর, উমানন্দ, কেদারনাথ, সোমনাথ, তারকনাথ এবং আদিনাথ।
মূল মন্দিরের গর্ভগৃহে মা কৃপাময়ী কালী মূর্তির অবস্থা। এখানে মা দক্ষিণাকালী। শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মাকে মা বলে সম্বোধন করতেন, আর বরাহনগরের দুই প্রান্তে অবস্থিত ব্রহ্মময়ী আর কৃপাময়ী কালীকে মাসী বলে সম্বোধন করতেন। এই তিনটি মন্দিরের মধ্যের দূরত্ব কিন্তু খুব একটা বেশি নয়। এই মন্দিরের অন্যতম উৎসব ছিল কালীপুজো। এক সময় মহাসমারহে মায়ের পুজো হত। বিশেষ করে দীপান্বিতা অমাবস্যায়। তখন পুজোয় বলিও হত। কিন্তু মিত্র পরিবারের কূলগুরু বালানন্দ ব্রহ্মচারীর নির্দেশেই বলিপ্রথা বন্ধ হয়ে যায়।
মন্দিরের বাম দিকে তুলসী মঞ্চের এক পাশে দেওয়ালে একটি ফলক দেখা যায়। সেই ফলকেই বালানন্দ গুরুদেবের উল্লেখ রয়েছে।
ফলকে লেখা রয়েছে,
সিন্ধু বিন্দু নেত্র চন্দ্র পরিমিত সনে
পূর্নানন্দে সাথে করি এক শুভক্ষণে
বালানন্দ ইষ্টদেব আসিয়া হেতায়
হেরিলেন জীববলি আর্ত বেদনায়
ক্ষান্ত করো রক্তস্রোত দিলেন বিধান
সে বিধান মেনে নিল ভক্ত পুণ্যবান।
-- তারানন্দ ও কৃষ্ণানন্দ।
ফলকের প্রথম লাইনটির সংখ্যা দিয়ে ব্যখ্যা সম্ভব। সংকেতের শব্দ অনুযায়ী, সংখ্যা বসিয়ে পাঠোদ্ধার করা হলে পাওয়া যায়, সিন্ধু অর্থাৎ ৭, বিন্দু অর্থাৎ ০, নেত্র মানেই ৩ এবং চন্দ্র অর্থাৎ ১ তাহলে দেখা যায় সংখ্যার হিসেব অনুসারে, বাংলার ১৩০৭ সনে অর্থাৎ ১৯০০ সালে বালানন্দ ব্রহ্মচারী এই মন্দিরে এসেছিলেন। সঙ্গে পূর্ণানন্দও ছিলেন। কূলগুরু নির্দেশে মন্দিরে বলিপ্রথা বন্ধ হয়ে যায়।
আজও এই মন্দিরে মা নিত্য পূজিতা। তবে পুজোয় এখন আর সেই জাঁকজমক নেই। ভক্তি সহকারে, শুদ্ধাচারে মায়ের পুজো হয়। স্থানীয় মানুষদের বিশ্বাস, মা খুবই জাগ্রত।