“আমার চরিত্রের একটা দুর্বলতা আছে, আমি পজিটিভ থিংকিং- এ বিশ্বাস করি। নেগেটিভ ভাবনায় জীবনের রং যেন আরও ময়লা, আরও ঘোলাটে দেখায়। ”
নিজের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বজায় ছিল সেই ‘পজিটিভ’ ভাবনা, তাই কলম থেমে যাওয়ার এক সপ্তাহ আগেও লিখতে পেরেছিলেন, “আমার তো হৃদকমল থেকে শ্বাসকমল সব দরজাই আধখোলা। তো এই কর্কটকমলের এত মাতব্বরি কীসের?”
কর্কটকমল ম্লান করতে পারেনি তাঁর ভালবাসার বারান্দায় এসে পড়া সকালের রোদ্দুরকে। রোগ, তাপ, দহনকে উপেক্ষা করে সেখানে চাঁপা ফুটেছে।
এখন সে বারান্দা ভিজে। আকাশ ভাঙা বৃষ্টিতে জল থইথই মগ্নতা।
ঘুম ভেঙে বৃষ্টি দেখলে মাঝে মাঝে এরকম
হয় তখন প্রার্থনা করি হে আকাশ
ঘর ভেঙে আরো বৃষ্টি দাও।...
হেমন্ত শূন্য করে চলে গেলেন শব্দের ঈশ্বরী। ৮১ বসন্ত যাপন করেছিলেন এই ভূমিতেই। এ শহর তাঁকে চিনেছিল ‘নবনীতা’ নামে। নবনীতা দেবসেন।
‘নবনীতা’ নামখানি রবি ঠাকুরের দেওয়া। আবাল্য বড়ো হয়েছেন সাহিত্যের পরিবেশে। নিজেকে নিয়ে বলতেন আমার জন্ম হয়েছে সাহিত্যিকের গর্ভে, সাহিত্যিকের ঔরসে।
জন্ম দক্ষিণ কলকাতার হিন্দুস্তান পার্কের ভালবাসা বাড়িতে। সাহিত্যিক নরেন্দ্র দেব এবং রাধারাণী দেবীর একমাত্র সন্তান।
বাংলা সাহিত্যের জগতে নক্ষত্রের মত বাবা-মার ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে নিজের স্বাধীন ভাষা তৈরির চেষ্টা জীবনের শুরু থেকেই। জীবনকে দেখেছিলেন সহজ কথার দৃষ্টিতে। তাই জটিল কথাগুলোও বলতে পেরেছিলেন আটপৌরে ভাষায়।
বৃষ্টিতে পেতেছি মুখ,
সিক্ত কেশে ঢেকেছি শরীর
এবার উপরে চোখ তুলে
প্রথম প্রত্যয়ে বলি
অসংকোচ নির্ভার আলোয় বলি;
-সব গেছি ভুলে।
কবিতায় যে কথা বলতে পারেননি তিনি সেই কথা বলার জন্য গদ্যের ভাষাকে বেছে নিলেন। প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাসে ধরা দিয়েছে তীক্ষ্ণ মেধা। সমাজ এবং জীবনকে পর্যবেক্ষণ করার মনন।
লিখেছিলেন, “ সেতু বন্ধনই শিল্পের কাজ। সেতু বন্ধনই জীবনেরও কাজ।…কোনও সৎ শিল্পীই জীবনকে উপেক্ষা করেন না, হয়ত বা শত্রুভাবেও ভজনা করে। জীবনকে স্পর্শ করার তীব্র ইচ্ছে আর আহত হওয়ার ভয়, দুটো যখন একসঙ্গে কাজ করে তখনই এই ‘বিচ্ছিন্নতার’ উৎপত্তি হয় মানুষের মধ্যে।”
সাহিত্যে মেয়েদের আলাদা স্বর তৈরির জন্য তিনি আজীবন কাজ করেছেন। মানবী বিদ্যা এবং মানবী সাহিত্যের পরিসরে তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের মুখ। অক্সফোর্ড, হাভার্ড, কলম্বিয়া সহ পৃথিবীর প্রথম সারির সব বিশ্ববিদ্যালয়েই আমন্ত্রিত অধ্যাপক ছিলেন।
‘নারীবাদ’ তাঁর কাছে আলাদা কোনও ভাবনা হয়ে থাকেনি। প্রতিবাদটা পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। ষোড়শ শতকে ময়মনসিংহের মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর জীবন এবং বিংশ শতাব্দীর নারীদের জীবন নিয়ে কাজ করেছিলেন। ‘চন্দ্রাবতী রামায়ণ’ তাঁর অন্যতম জরুরী কাজ। সীতার চোখে দেখা ‘রামকথা’। মহাকাব্যের যুগ থেকে আর্থ-সামজিক প্রেক্ষিতে মেয়েদের অবস্থান।
লিখেছেন ছোটদের জন্য লেখাও। রূপকথার গল্পগুলো আধুনিক শিশু সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদ।
সেখানেও পাওয়া যেত ‘পজেটিভ স্পার্ক’। নিজের লেখা রূপকথা প্রসঙ্গে বলতেন, সব সময় জয় হবে ভাল মানুষের। গায়ের জোর জরুরী নয়। বুদ্ধির জোর আর হৃদয়ের জোর আসল। ছোটদের জানাতে হবে সে কথা।
নবনীতা জানতেন একাধিক ভাষা। বাংলা, ইংরেজি ছাড়াও হিন্দি, মারাঠি, জার্মানি ভাষায় ছিল তাঁর দখল।
একবিন্দু অশ্রুজলে এনে দিতে পারতেন সমুদ্রকে। বদলে দিতে পারতেন পাঠক মনের সম্পূর্ণ ভাবকে। তাঁর পাঠকদের কাছে তাঁর জীবন ছিল খোলা বইয়ের মতো। যার প্রতিটি পাতা পাঠকের জানা। পাঠক-লেখকের মধ্যে কোথাও কোনও আবছাইয়া নেই। অবগুণ্ঠন নেই।
তবু তিনি বলেছিলেন, “... আমি হাসির গল্প লিখতে শুরু করলুম। পাঠকদের কৌতূহল এবং করুণা নিবৃত্তির জন্য এটাই সবচেয়ে ভাল উপায়। আমার জীবনে যে অনেক হাসি আছে, মজা আছে, অনেক আলো-বাতাস আছে সেটা সবাইকে জানিয়ে দেওয়াই ভাল।”
তিনি পাঠকের কাছে অনেকটা উৎসবের আলোর মতো। যাঁর রশ্মি গায়ে এসে লাগলেই অন্ধকারগুলো মিলিয়ে যায়। সে আলো সদা বিভাময়। মৃত্যু তাকে স্পর্শ করতে পারে না। নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারায় তাঁর বয়ে যাওয়া। তেমনি এক আলোকলতা হয়ে অনুরাগী হৃদয়ের বারান্দা জুড়ে থাকবেন নবনীতা।