‘নিজের লেখার প্রেমে পড়ে যেতে নেই, নিজের লেখাকে নিজেই সমালোচনা করতে হয়। ভালোবাসতে হয় এবং দূরে দাঁড়িয়ে পড়তে হয়’।
লেখার প্রতি এই ছিল তাঁর মনোভাব। এক সংবাদপত্র সাক্ষাৎকারে একবার জানিয়েছিলেন লেখার দর্শন নিয়ে মতামত দিতে গিয়ে।
ছোটবেলা জেনেছিলেন লেখাটাই বোধহয় মানুষের একমাত্র কাজ। তাঁর চোখে দেখার জগৎটাও ছিল তেমনি। বাবা লিখছেন, মাও লিখছেন, তাঁদের বন্ধুরাও সবাই লেখার জগতের মানুষ। বাড়িতে লেখক-সাহিত্যিকদের আনাগোনা।
বেঁচে থাকার জন্য লেখালেখিই একমাত্র কাজ।
শ্বাসবায়ুটুকুও যেন বইত লেখা দিয়ে। লেখা মানে জীবন। এর বাইরে আর কিছু থাকতে পারেনা। অক্ষরবৃত্তে আবর্তিত হত নবনীতার জীবন।
নবনীতা দেবসেন মানেই গল্পের টানে বুদবুদিয়ে ওঠা জীবনের ব্যাপ্তি। সব টুকু রূপ-রস গন্ধ নিয়ে ধরা দিয়েছে কলমের আখরে।
সেভাবেই এক হয়েছেন নবনীতা আর পাঠক।
পাঠকদের বড় কাছের তিনি। লেখক, কিন্তু লেখক নয়। চাইলেই যেন হাত রাখা যায় হাতে। এমনই নিবিড় ছিলেন তিনি পাঠকদের সঙ্গে। কেউ পর নয়। সবাই দাঁড়িয়ে আছে এক বারান্দায়। চলছে গল্প, আড্ডা।
রান্নাঘর- বৈঠকখানা-বারান্দায় থইথই বেঁচে থাকার গল্পগুলো পথ চলতে চলতে হঠাৎই বাঁক বদলে হয়ে যেত বিশ্বজনীন। প্রায় এক মোচড়ে পাঠক বাড়ির উঠোন থেকে একেবারে রানওয়ে দৌড় যাকে বলে ।
নবনীতার গদ্য একবার পড়তে শুরু করলে আর থামা যায় না। লেখার আধারে এক হয়ে যায় বহির্জীবন আর অন্তরজীবনের ফারাক। মুহুর্তে বদলে যায় দেখা।
নবনীতা লিখেছেন,
“ কোথায় গেল আমার সেই চোখ, যা সকলকে সুন্দর দেখতো? কোথায় সেই মন, যা সবেতেই আশ্চর্য হোতো? জীবন, হে জীবন মহারাজ, দয়া করে ফিরে নাও তোমার চালশের এই চশমা আমি আর স্পষ্ট দেখতে চাই না, আমি শুধু রম্য দেখতে চাই। কে তুমি হে আমার এই চোখের কোটরে এসে বসেছো, রংবেরঙের কড়া আলো ফেলে পালটে দিচ্ছ দৃশ্যপট,আমি আর স্বচ্ছ দেখতে পাচ্ছিনে কেন?
এই জিজ্ঞাসা তাঁর নিজেকে নিজের। কিন্তু পড়তে গিয়ে শব্দের সঙ্গে এক হয়ে যায় পাঠকও।
লেখায় কোনও দেওয়াল ছিল না। তাঁর লেখা সবার। মুক্তস্রোতের গতিতে এগিয়ে চলে লেখনি, ডুব দিলেই তলিয়ে যাওয়া। গুরুতর বিষয় ধরা দিত সহজ কথার অন্দরে।
‘কয়েকদিন ধরে নোটবইতে কেবল খবরের কাগজের হেডিং টুকে রাখব ঠিক করেছি। কত সুন্দর সুন্দর হেডিং- তা থেকে কলকাতা শহরের তথা পশ্চিমবঙ্গের সুব্যবস্থার চেহারা চমৎকার ফুটে ওঠে।’
রোজকার বেঁচে থাকার বিপর্যয় নিয়ে তৈরি হত গদ্যের শরীর। সাহিত্যের প্রায় সমস্ত ধারাতে দিয়ে কাজ করেছেন। তবে কবিতা সব সময় তাঁর নিজের ঘর। লেখকের নিজের কথা, পরিবারের কথা, আনন্দ-বেদনার কথা পড়তে পড়তে পৌঁছে যেতে হয় আন্তর্জাতিকে।
তবে গদ্য-কবিতা-প্রবন্ধ বা রূপকথা যাই লিখেছেন সবেতেই মিশেছে নিজের মনের ছন্দ। কাজ করেছেন রামায়ণ নিয়ে। ছোটগল্পে এসেছে রামায়ণের সাবভার্সান। সীতা, লক্ষ্মণ, সুর্পনখা, হনুমানের মতো চরিত্ররা গল্পের ভূমিকায় এসেছে অন্যভাবে। প্রচলিত ভাবনার মূলে আঘাত করেছে তারা। মূলকাহিনী থেকে এক চুল না সরে বদলে গিয়েছে দর্শন। পুরুষতান্ত্রিক মহাকাব্যের গভীরে জেগেছে নারীর স্বর। সরসতার মধ্যেও জেগে উঠত প্রতিবাদ।
গুরু গম্ভীর বিষয়ের ভার নেই সেখানে, আছে সহজ, সরস গল্পের গতি। পড়তে পড়তে হেসে ওঠে পাঠক।
নিজেকে বলতেন নারীবাদী লেখক। কিন্তু সেই নারীবাদ কোনভাবেই পুরুষবিরোধী নয়। কোনও বিদ্বেষ নেই। কিন্তু প্রশ্নবাণের কেন্দ্রে পুরুষতন্ত্র।
লড়াকু মানুষটি পুরোপুরি বেরিয়ে আসত কলমের মুখে। সে সব লেখায় রাগ, দুখ, হতাশা, অভিমানের পাশাপাশি থাকত মানুষকে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা। কিন্তু ভারী ঘরোয়া ভঙ্গীতে। অধরা নয় মেধার ঝিলিকও। মনে-মগজে একরাশ টাটকা আলোয় সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে পাঠক। ভেসে চলে নবনীতার গদ্যের স্রোতে...
তথ্যঋণ( নবনীতার নোটবুক, শব্দ পড়ে টাপুরটুপুর, প্রথম আলো, scroll.in)