জ্ঞানচর্চার গরিমা আর ভক্তিরসের ধারায় বিধৌত এই ভূমি মহাপ্রভুর লীলাভূমি। কৃষ্ণপ্রেমের সুরে আজও আমোদিত এখানকার আকাশ-বাতাস। সেই টানেই দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসে পর্যটকরা। নবদ্বীপ যেন আলাদা এক পৃথিবী।
ট্রেন বা গাড়ি, আসার পথ যাই হোক না কেন পথিককে বাতাস বলে দেবে সে চৈতন্য ভূমির কাছাকাছি এসে পড়েছে।
লোকবিশ্বাস বলে নয়টি ব-দ্বীপ নিয়ে তৈরি এই হয়েছিল নবদ্বীপ। তার আকৃতি অষ্টদল পদ্ম। মানে আট পাপড়ির এক পদ্মের মতো, মাঝখানটিতে আছে অন্তদ্বীপ। এই নয়টি দ্বীপ যথাক্রমে- অন্তদ্বীপ, সীমান্ত দ্বীপ, গোদ্রুমদ্বীপ, মধ্যদ্বীপ, কোলদ্বীপ, ঋতুদ্বীপ, মোদদ্রুম দ্বীপ, জহ্নুদ্বীপ, আর রুদ্রদ্বীপ।
এই নয়টি দ্বীপের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মহাপ্রভুর নানা লীলা পর্ব। লোকমুখে ঘুরে বেড়ায় তার কাহিনি।
১)অন্তদ্বীপ- নবদ্বীপের মায়াপুর, ভারুই ডাঙ্গা এর অন্তর্ভুক্ত। লোক কথা অনুযায়ী এখানেই জন্মগ্রহণ করেন চৈতন্যদেব। দ্বাপর যুগে ব্রজবিহারের সময়ে প্রজাপতি ব্রহ্মা সখাগণ সহ গোবৎস হরণ করেন। সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবার জন্য শ্রীকৃষ্ণে ব্রহ্মাকে সঙ্গে নিয়ে নবদ্বীপ ধামে অবতীর্ণ হন।
২) সীমান্ত দ্বীপ বা সিমুলিয়া গ্রাম- কথিত আছে, মহাদেবের কাছে গৌরলীলা পাঠ শ্রবণ করে পার্বতীর ইচ্ছা হয় নবদ্বীপ ধামে গৌরাঙ্গ মূর্তি দর্শনের। তখন শ্রীকৃষ্ণ পার্বতীকে নিয়ে এই দ্বীপে আসেন এবং গৌরাঙ্গ মূর্তিতে প্রকট হন। এই রূপ দর্শন করে পার্বতী স্বয়ং গৌরাঙ্গরূপী মূর্তিকে প্রণাম করেন এবং এখানকার মাটি নিয়ে সীমান্ত অর্থাৎ সিঁথিতে ধারণ করেন। তাই এই জায়গার নাম সীমান্ত দ্বীপ।
৩) গোদ্রুমদ্বীপ- গাদিগাছা, সুবর্ণবিহার অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। সুরভি গাভীসহ এই স্থানে নাকি এসেছিলেন দেবরাজ ইন্দ্র। তাঁর প্রার্থনায় পুনরায় শ্রীকৃষ্ণ ফের গৌরাঙ্গ রূপে দর্শন দিয়েছিলেন। এই দ্বীপভূমিতেই।
৪) মধ্যদ্বীপ বা মাজদিয়া- গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু নবদ্বীপ ধামে জন্মগ্রহণ করার আগে সপ্তঋষিরা এখানে এসে মহাপ্রভুর আবির্ভাবের বার্তা প্রচার করা শুরু করেছিলেন। কোন এক মধ্যাহ্নে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ সেই সপ্ত ঋষিদের দর্শন দেন। মধ্যাহ্ন থেকে দ্বীপের নাম হয়েছে মধ্য দ্বীপ।
৫) কোলদ্বীপ- এই দ্বীপভূমিতে এক বিষ্ণু ভক্ত ব্রাহ্মণকে শ্রীকৃষ্ণ বরাহ অবতার রূপে দর্শন দিয়েছিলেন।
৬) ঋতুদ্বীপ- শোনা যায়, নারদের আকুল ডাকে সাড়া দিয়ে এই দ্বীপে শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হন এবং খুব শীঘ্রই ঋতুরাজ বসন্তকালে শ্রীগৌরাঙ্গ রূপে জন্মগ্রহণ করবেন বলে জানান।
৭) মোদদ্রুম দ্বীপ- রামচন্দ্রের বনবাসকালে শ্রীরামচন্দ্র থেকেছিলেন এখানে। এখানেই নাকি তিনি দেবীসীতাদেবী গৌরলীলা দর্শন করিয়েছিলেন।
৮) জহ্নুদ্বীপ- জাহান্নগর বা জাননগর বা জানুনগর। এইখানে ছিল জহ্নু মুনির আশ্রম। ইনি গঙ্গা অবতরণের সময় এক গণ্ডুষে সম্পূর্ণ গঙ্গার জল পান করেছিলেন। পরে ভগীরথের প্রার্থনায় নিজের জানু চিড়ে ফেলে গঙ্গার জলধারাকে মুক্ত করেন।
৯) রুদ্রদ্বীপ- এই স্থানে গৌরাঙ্গ জন্মের পূর্বে গৌরসুন্দরের আগমন বার্তা প্রচার করা রুদ্রদেবের সম্মুখে স্বয়ং নবদ্বীপ এর গৌরাঙ্গ রূপে শ্রীকৃষ্ণ প্রকট হয়েছিলেন।
মধ্যযুগে নবদ্বীপ ছিল সংস্কৃত শাস্ত্র ও দর্শন চর্চার পীঠস্থান। শাক্ত, শৈব, বৌদ্ধ এবং বৈষ্ণব এই চার পথ মিলেছিল এই মাটিতে। ব্রিটিশরা নবদ্বীপকে বলত বাংলার অক্সফোর্ড।
একসময় বঙ্গের রাজনীতি আবর্তিত হত নদীয়া-নবদ্বীপকে কেন্দ্র করে। ১১৯৫ থেকে ১২০৬ পর্যন্ত ছিল সেন রাজাদের রাজধানী। তারপর বখতিয়ার খিলজি দখল করে নেন নবদ্বীপ।
পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে পর্যটনক্ষেত্র হিসেবে নবদ্বীপকে হেরিটেজ শহর ঘোষণা করেছে। দু’রকম টানে মানুষ নবদ্বীপ আসে। ভক্তিরস এবং জ্ঞানরস।
হিংসা-ধ্বংস আর মদমত্তে ক্রমশ উষ্ণ হয়ে চলা পৃথিবীর বুকে নবদ্বীপ আজও কথা বলে প্রেম আর সুরের ভাষায়। আজকের গতিজীবনে সব কানে সেই সুর হয়ত পৌঁছায় না কিন্তু যে কান সেই সুর একবার শুনেছে তার হৃদয়ের দরজা খুলবেই। ইচ্ছে যাবে গৌরভূমি ঘুরে আসার।
হাতে একদিন বা সপ্তাহান্তে ঘুরে আসা যায় নবদ্বীপ। হাওড়া ও শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে যাওয়া যায়। সময় লাগে ২ ঘন্টার কম। গাড়ি ও বাসেও যাওয়া যায়। পার হতে হয় জলঙ্গী।
রাস উৎসব, জন্মাষ্টমী,ঝুলন, শাক্তরাস, কালী পুজোর সময় নবদ্বীপে উৎসব হয়। ঘুরে দেখার জায়গাও প্রচুর।
চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্থান মন্দির- অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার ব্রজমোহন দাস বাবাজি নবদ্বীপ শহরের উত্তরে রামচন্দ্রপুরে অসংখ্য কূপ খননের মাধ্যমে গৌরাঙ্গ-জন্মস্থান নির্ণয় করেন। ৩০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট নবরত্ন এই মন্দিরটি ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়। গৌড়ীয় মন্দিরশৈলীর এই মন্দিরের শিখর চূড়াটি বৃহদাকৃতির হলেও অন্যান্য ৮টি চূড়া ক্ষীণাকার।
বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর জন্মস্থান- চৈতন্যদেবের দ্বিতীয় স্ত্রী বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী এখানে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মভিটের এই মন্দিরে বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী ও মহাপ্রভুর অতিসুন্দর দারুবিগ্রহ আছে।
ধামেশ্বর মহাপ্রভু মন্দির- ধামেশ্বর মহাপ্রভু মন্দিরের বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী পূজিত শ্রীবিগ্রহ নবদ্বীপের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। মহাপ্রভুর সন্ন্যাস গ্রহণের পর বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী স্বপ্নাদেশ পেয়ে বংশীদাস নবীন ভাস্করকে ডেকে প্রভুর বাড়ির নিম গাছটি দিয়ে মহাপ্রভুর এক অপরূপ দারুবিগ্রহ নির্মাণ করান। বিগ্রহের পাদদেশে খোদিত আছে বংশীর প্রাণধন গৌরাঙ্গ সুন্দর।
মা ভবতারিণী মন্দির- নদীয়ারাজ মহারাজা রাঘব ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে নবদ্বীপের গঙ্গার ধারে মন্দিরসহ প্রকাণ্ড এক গণেশ মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। তার মৃত্যুর ১০০ বছর পর গঙ্গার ভাঙনের কারণে বিগ্রহ অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পণ্ডিতবর্গের বিধানে বিগ্রহটিকে ১২ বছর মাটির নিচে রাখা হয়। পরবর্তীতে বিগ্রহটিকে মাটি থেকে তোলার সময় গণেশের শুঁড়টি ভেঙে গেলে মহারাজ গিরিশচন্দ্রের আদেশে কোনো এক অজ্ঞাত শিল্পী গণেশ মূর্তি থেকে মহারাজের আরাধ্যা দেবী আনন্দময়ীর প্রতিমা তৈরি করেন এবং দেবীমূর্তির নামকরণ হয় ভবতারিণী মাতা। ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে মহারাজা গিরিশচন্দ্র পোড়ামাতলায় দালানের উপর চারচালা মন্দির নির্মাণ করে দেবীকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
পোড়ামা কালীমন্দির- পোড়ামা নবদ্বীপের অধিষ্ঠাত্রী দেবী।দেবী পোড়ামা বা বিদগ্ধজননী নামে পরিচিতা। বটবৃক্ষমূলে দুটি ইটের উপর সংস্থাপিত ঘটে দক্ষিণাকালিকার ধ্যানে দেবীর নিত্য পূজা হয়। পোড়ামাতার প্রাচীনত্ব সম্পর্কে কোনও সঠিক ধারণা পাওয়া যায় না। কোনও এক সময়ে বটবৃক্ষ অগ্নিদগ্ধ হলে সেই স্থান পোড়াবটতলা ও দেবী পোড়ামা বা বিদগ্ধজননী নামে খ্যাত হয় মনে ইতিহাসবিদরা মনে করেন।আবার অনেকে পড়ুয়ার মা অর্থে বিদ্যাদেবী বা নীল সরস্বতী মনে করেন। সারাবছর দক্ষিণাকালিকার ধ্যানে পূজা হলেও সরস্বতী পুজোর দিন নীল সরস্বতীর ধ্যানে দেবীর পূজা হয়।
ভবতারণ শিব মন্দির- গৌরীপট্ট সংবলিত ব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃতির প্রথম শিব মূর্তিটি ১৬৮৩ থেকে ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রাজা রুদ্র রায় স্থাপন করেছিলেন। সেইসময় শিবমূর্তিটি রাঘবেশ্বর শিব নামে পরিচিত ছিল। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দের গঙ্গার ভাঙনে মন্দিরসহ মূর্তিটি গঙ্গাগর্ভে নিমজ্জিত হলে রাজা গিরিশচন্দ্র ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে পোড়ামাতলায় শিব মূর্তিটি ভবতারণ নামে পুন:স্থাপিত করেন, যা বর্তমানে ভবতারণ শিব নামে পরিচিত।
নবদ্বীপ মণিপুর রাজবাড়ি- কাঁঠালকাঠ নির্মিত মণিপুরী ঘরানার অনুমহাপ্রভুর বিগ্রহ ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে এখানে মণিপুর রাজপরিবার দ্বারা পূজিত হয়ে আসছে। দোলযাত্রা ও রাস পূর্ণিমায় এখানে অতিসাড়ম্বরে পূজার্চনা হয় ও মণিপুরি নৃত্য পরিবেশিত হয়।
বুড়োশিব মন্দির - নবরত্ন মন্দিরশৈলীর এই মন্দিরটি ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে তারাপ্রসন্ন চূড়ামণির চেষ্টায় নির্মিত হয়। আদি মন্দিরটি সপ্তদশ শতাব্দীর দিকে নির্মিত হয়। মন্দিরের বুড়োশিব মূর্তিটি প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের প্রাচীন। নরহরি চক্রবর্তী রচিত শ্রীশ্রীগৌরচরিত চিন্তামণি বিজয় সেনের তীর্থমঙ্গল গ্রন্থে বুড়োশিবের সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। এখানে শৈব সংস্কৃতির অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে গাজন, চরক, শিবের বিয়ে, শিবরাত্রি উল্লেখযোগ্যভাবে পালিত হয়।
বড় আখরা- বড় আখরা নবদ্বীপের প্রথম বৈষ্ণব আখরা। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে তোতা রামদাস বাবাজি কর্তৃক এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বড় আখড়ার নাটমন্দিরটি ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে মাধবচন্দ্র দত্ত নির্মাণ করেন।
শ্রীবাস অঙ্গন- তোতা রামদাস বাবাজির শিষ্য লছমন দাস পুরাণগঞ্জের রাধী কলুর ভিটায় ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে শ্রীবাস অঙ্গন প্রতিষ্ঠা করেন। এই অঙ্গন গঙ্গাগর্ভে নিমজ্জিত হলে নবদ্বীপের কংস ব্যবসায়ী গুরুদাস দাস ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান শ্রীবাস অঙ্গন প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে মাতা বসুধা ও মাতা জাহ্নবাসহ নিত্যানন্দ প্রভু এবং পঞ্চতত্ত্ব ছাড়াও ৩৭ জন চৈতন্য পরিকরের সুষমামণ্ডিত দারুবিগ্রহ পূজিত হয়।
বুনো রামনাথের ভিটা - অষ্টাদশ শতাব্দীর নবদ্বীপের বিশিষ্ট নৈয়ায়িক, পণ্ডিত ও এবং আদর্শ শিক্ষক বুনো রামনাথ এই স্থানে চতুস্পাঠী স্থাপন করে শিক্ষাদান করতেন। বুনো রামনাথের ভিটেতে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত বাংলার নবদ্বীপ তথা ভারতের সুপ্রাচীন শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে ওঠে। পাইকপাড়ার রাজা ইন্দ্রচন্দ্র সিংহের সভাপতিত্বে এবং অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মহেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় দেশের পণ্ডিতমণ্ডলী এবং সংস্কৃতের অধ্যাপকদের নিয়ে সংস্কৃত চর্চাকে পুনঃজাগরণের উদ্দেশ্যে বঙ্গ বিবুধ জননী সভা স্থাপন করা হয়েছিল।
রানী রাসমণি কাছারিবাড়ি- নবদ্বীপের জমিদারি পাওয়ার পর রানী রাসমণি জমিদারি রক্ষা ও খাজনা আদায়ের জন্য এই কাছারি বাড়ি তৈরি করেন। এখানে রানী রাসমণি সেবিত রাধাগোবিন্দ জিউ ও গৌরাঙ্গ জিউর মন্দির বর্তমান।
তথ্য সূত্রঃ নবদ্বীপ ধামের ইতিহাস ও শ্রীচৈতন্যলীলা মাধুর্য্য, কৌলাল পত্রিকা