নববর্ষের আড্ডা - বইপাড়ার ঐতিহ্য

বাংলা নববর্ষের জন্ম নিছক আর্থিক কারণে, খাজনা আদায়ের পুণ্যাহ আজ হয়ে উঠেছে বাঙালি বঙ্গ সংস্কৃতি উদযাপনের উৎসব। মিশে গিয়েছে পুজো, হালখাতা ও সংস্কৃতির যাপন। উদযাপনে সামিল হত বইপাড়া, বলা ভাল আজও সামিল হয় বইপাড়া। প্রকাশকের ঘরে গণেশ, লক্ষ্মীর আরাধনা হয়, ব্যবসা বলে কথা। নিমন্ত্রণ পত্র আসে লেখকদের নামে। মিষ্টিমুখ চলে। প্রভাতফেরি, গণেশ পুজো, খেরোর খাতা, মিষ্টি, ডাবের জল, আড্ডা, গল্প, নতুন বই প্রকাশ, লেখক, প্রকাশক; এসবেরই মধ্যে দিয়েই নববর্ষের প্রথম দিনটা কাটায় বইপাড়া। প্রকাশক-লেখক-পাঠকের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ছবি ধরা দেয় এদিন। খ্যাতনামা সাহিত্যিক থেকে নবাগত লেখক, সব্বার দেখা মেলে এদিন। 

পয়লা বৈশাখ মানেই উৎসব, সেই উৎসবের ঢেউ পৌঁছত বইপাড়াতেও। নববর্ষে প্রকাশনা সংস্থার ঘর আলো করে বসে থাকতেন সাহিত্য জগতের দিকপালরা, আজ এই রীতি চলছে। নববর্ষ উপলক্ষ্যে কদিন আগে থাকতেই বইপাড়ায় সাফাই চলত, বইয়ের দোকান পরিষ্কার করা হত। তারপর রঙের প্রলেপ পড়ত। দিন পনেরো আগে থেকেই শুরু হয়ে যেত তোড়জোড়।

পয়লা বৈশাখের সকালে পুজো হত। তারপর অনাবিল আড্ডায় মেতে উঠতেন সকলেই। আটপৌড়ে বাঙালিয়ানা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকত সে আড্ডায়। লাল খাতায় লেখকরা ওই দিনে তাঁদের মতামত লিখে স্বাক্ষর করতেন। শিল্পীরা ছবি এঁকে দিতেন। কবিদের কবিতা থাকত। ফুলের গন্ধে কলেজ স্ট্রিট ভরে যেত। সঙ্গে ছিল পাত পেড়ে খাওয়াদাওয়া। নতুন বছরে প্রকাশকের ঘরে লেখকদের খাওয়াদাওয়ার এলাহি আয়োজন থাকত। পাবলিকেশন হাউসগুলিতে ঠাকুর আনিয়ে রান্না হত। কারিগর ডেকে ভিয়েন বসিয়ে মিষ্টি তৈরি করিয়ে নিতেন প্রকাশকরা। লীলা মজুমদার, তাঁর 'খেরোর খাতা'-তে বইপাড়ার নববর্ষের বর্ণনা দিয়েছেন। ডাবের জল আর সুগার ফ্রি সন্দেশ সহযোগে লেখকদের আপ্যায়ণের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। ক্ষীরের সন্দেশ দেওয়া হত। ছাড় দিয়ে বই বিক্রির রেওয়াজ স্টল ছিল। প্রকাশনাগুলির তরফে নতুন বইয়ের ক্যাটালগ গোছের লিস্ট বিতরণ করা হত। শরবত পানীয়, সন্দেশ দেওয়া হত লেখকদের। পাঠকরাও আসতেন।

কোনও কোনও লেখকের সঙ্গে এই দিন বার্ষিক চুক্তি হত। নববর্ষে নতুন বই প্রকাশের রেওয়াজ ছিল। এখনকার মতো সারা বছর বই বেরোনোর চল ছিল না। বছরে তিনটি উৎসবে বই প্রকাশের ঢল নামত, বইমেলা, নববর্ষ আর দুগ্গাপুজো। নববর্ষে বইয়ের কেমন চাহিদা থাকত উদাহরণ দিই? ১৩৮৫ সনের পয়লা বৈশাখ, নববর্ষে উপলক্ষ্যে মিত্র ও ঘোষ থেকে পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস বইটির চারটি খণ্ড একত্রে প্রকাশিত হবে। ভোরবেলা থেকেই লাইন পড়ে গেল। দোকান খুলবে এগারোটায়।

লাইন সংস্কৃত কলেজ ছাড়িয়ে গেল। মাত্র তিন হাজার কপি ছেপে এল! সে যুগে মাত্রই বটে। পিওডি আর গুচ্ছ গুচ্ছ বেস্ট সেলার তখন ছিল না। দুপুর একটার মধ্যে তিন হাজার কপি শেষ। কিছুক্ষণ বাদে আরও তিন হাজার বই এল। বিকেল পাঁচটাতেও লাইন কমে না। সব বই শেষ! পরিস্থিতি সামল দিতে আমহার্স্ট স্ট্রিট থানাকে আসরে নামতে হয়েছিল। পুলিশ এসে লাঠিচার্জ করতে বাধ্য হয়।

১৩৮৮ সালেও প্রায় এমন কান্ড ঘটেছিল শংকরের ট্রিলজি 'স্বর্গ-মর্ত-পাতাল'কে ঘিরে। লেখকের সই নিতে উপচে পড়েছিল ভিড়। 

সেকালের বইপাড়া আজকের মতো ছিল না। কলেজ স্ট্রিটে ট্রাম লাইন তথা রাস্তার দু-ধারে প্রকাশনাগুলোর দপ্তর এবং বিপণন কেন্দ্র ছিল। শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটে তখন বড় বইয়ের দোকান ছিল নামমাত্র। কলেজ স্কোয়ারের পূর্বদিকেও কিছু বইয়ের দোকান ছিল। কলেজ স্কোয়ারের চারধারে সে সময় স্টল ছিল না। পুরনো বইয়ের কিছু দোকান ছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজের রেলিংয়ে রেখে এবং সামনে ফুটপাথে পুরনো বই বিক্রি হত। নববর্ষের দিন বইপাড়ার ছবিটা বদলে যেত। বইয়ের দোকানে দোকানে নতুন খাতা ও গণেশ পুজো করা হত। দোকানগুলোর দরজায় আমপাতা, সোলার কদমফুল দিয়ে সাজানো হত। নতুন খাতা নিয়ে বইয়ের দোকানের মালিকরা কালীঘাট, ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি বা দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিতে যেতেন। 

সন্ধেবেলা থেকে ক্রেতাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হত। মিষ্টি, নোনতা খাবারের ব্যবস্থা থাকত। পয়লা বৈশাখের বইপাড়ায় এম. সি. সরকার অ্যান্ড সন্স এবং মিত্র-ঘোষ পাবলিশার্সের আড্ডার খ্যাতি ছিল চরম। এম. সি. সরকারে কর্ণধার সুধীর সরকার হতেন মধ্যমণি, আশেপাশে থাকতেন প্রবীণ লেখকরা। এই আড্ডার নাম ছিল হাউস অব লর্ডস। অন্যদিকে, মিত্র-ঘোষের গজেন্দ্রকুমার মিত্র ও সুমথনাথ ঘোষের আড্ডায় নবীন সাহিত্যিকরা আসতেন। বইপাড়ার এই আড্ডার পোশাকি নাম হয়েগিয়েছিল হাউস অব কমনস্‌। নববর্ষের দিন অন্য চেহারা নিত গোটা বইপাড়া। বর্ষবরণের দুটো বিখ্যাত আড্ডা ছিল কল্লোল গোষ্ঠীর এবং শনিবারের চিঠির। দুই আড্ডার রেষারেষি এমন পর্যায়ে পৌঁছত, যে রবিঠাকুরকেও একবার আসরে নামতে হয়েছিল। দুই দলকে ডেকে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে বসে তাঁকে মিটমাট করতে হয়েছিল। অনেকেই বলেন নববর্ষের আড্ডার জনক ঈশ্বর গুপ্ত। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষ্যে তিনি একবার সংবাদ প্রভাকরের বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন এবং সেই উপলক্ষ্যে ভোজসভার আয়োজন করেছিলেন। শহরের তাবড় তাবড় লোকেরা তাতে আমন্ত্রিত ছিল।

আজও নববর্ষে বিভিন্ন প্রকাশনী বৈশাখী আড্ডার আয়োজন করে। লেখক-পাঠকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। মিষ্টিমুখ চলে। বইয়ের উপর বিশেষ ছাড় দেওয়া হয় নানান প্রকাশনা তরফে। কয়েক বছর ধরে কলেজ স্কোয়ারে নববর্ষের বইমেলা হয়। নববর্ষের আড্ডায় আজও বেঁচে আছে কলেজ স্ট্রিটের ঐতিহ্য।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...