দেবী দুর্গার বাহন হল সিংহ, এই সিংহ হিমালয়ের দান। রামচন্দ্র রাবণ বধ করার জন্যে যুদ্ধযাত্রা শুরুর আগে আশ্বিন মাসে দেবী দুর্গার অকাল বোধন করেছিলেন। সেটাই বঙ্গের শারদীয়া। এই সময় প্রতিবছর দেবী তাঁর সন্তান সন্ততি নিয়ে স্বর্গ থেকে মর্তে আসেন, সেই কারণেই বাহনের প্রয়োজন। দেবীর আগমন ও গমন হয় নৌকো, ঘোড়া, হাতি এবং পালকি চড়ে। একেক বার একেকটি। এদের আবার আলাদা আলাদা অর্থ রয়েছে। কোন বারে যাত্রা হচ্ছে তার উপর ভিত্তি করেই এগুলি ঠিক করা হয়। যদিও শাস্ত্র মতে এর কোনও ব্যাখ্যা মেলে না।
আদপে দেবী দুর্গা অর্থাৎ মহিষাসুরমর্দিনী হলেন সিংহবাহিনী। যদিও ভারতের বিভিন্ন স্থানে যে সমস্ত প্রাচীন মূর্তি পাওয়া যায় তাদের অনেকগুলোতেই দেবীর বাহন হিসেবে বাঘের দেখা মেলে। নবদুর্গার নয়টি রূপের মধ্যে চন্দ্রঘন্টা ও কুষ্মান্ডার বাহন বাঘ, আবার দেবী স্কন্ধমাতা ও কাত্যায়ণী হলেন সিংহবাহিনী। শ্রীশ্রীচণ্ডীর ব্যাখ্যা অনুসারে দেবতাদের সম্মিলিত তেজঃপুঞ্জ থেকে দেবী দুর্গার উদ্ভব হবার পর দেবকুল তাঁদের নিজ নিজ অস্ত্র ও অন্যান্য সামগ্রী দিয়ে দেবীকে যুদ্ধসাজে সজ্জিত করে তোলেন। তখন হিমালয় দুর্গাকে তাঁর বাহন সিংহ দান করেন। সিংহ রজোগুণের অধিকারী, প্রচণ্ড শক্তি ও উচ্ছ্বাসের প্রতীক এবং দেবী দুর্গা স্বয়ং অত্যন্ত বলশালিনী ও শৌর্যবতী বলেই সিংহের মত প্রাণীকে বশে রাখতে পারেন। সেই থেকে সিংহ দুর্গার বাহন হিসেবে স্বীকৃত বলে ধরে নেওয়া হয়।
বাংলায় মহিষমর্দিনী প্রতিমায় দুই রকমের মুখওয়ালা সিংহ দেখতে পাওয়া যায়। অনেক বনেদি পরিবারের প্রতিমার সিংহের মুখ অনেকটা ঘোড়ার মতো। এগুলোকে ঘোড়াদাবা সিংহ বলা হয়। দাবা খেলার ঘোড়ার ঘুঁটির মতো মুখ। এর কারণ হল, প্রাচীন কালে বাংলায় যেহেতু সিংহ দেখা যেত না তাই শিল্পীরা এখানকার চেনা ঘোড়াকেই কেশর লাগিয়ে সিংহের আদল দিতেন। পরে আঁকা ছবিতে সিংহের আসল চেহারা দেখে শিল্পীরা আসল সিংহের মতোই দেবীর বাহনকে গড়তে আরম্ভ করেন। আবার অনেকেই বলেন, দেবী যেহেতু যুদ্ধে অবতীর্ন হবে, আর যুদ্ধের অঙ্গই হল ঘোড়ার পৃষ্ঠে আহরণ, তাই দুই জিনিসকে বজায় রাখতেই ঘোটকমুখী সিংহের অবতারণা করা হয়েছিল।
অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায়, দেবী দুর্গার বাহন সিংহের মুখ ঘোড়ার মতো। কলকাতার মিত্রবাড়ির সিংহের মুখ ঘোড়ার মতো। এমন ঘোটকমুখী সিংহ বাংলার অনেক বাড়িতেই দেখা যায়। ঘোটকমুখী সিংহ নিয়ে নানান কিংবদন্তি ছড়িয়ে রয়েছে। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের শুরু করা দুর্গাপুজোর দুর্গা প্রতিমার বাহন ছিল ঘোটকমুখী সিংহ। ঘোটকমুখী সিংহের শরীরের আকৃতি সিংহের মতো,আর মুখ হল ঘোড়ার মতো। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদিয়াধিপতি কৃষ্ণচন্দ্র দুর্গা পুজোয় নতুন রীতি প্রচলন করে, মহালয়ার দিন থেকে শুরু করে সকলের মঙ্গলকামনায় টানা নবমী পর্যন্ত যজ্ঞ চলত। দেবী এখানে রাজরাজেশ্বরী, শক্তির প্রতীক। সেই কারণেই তিনি যোদ্ধাবেশী। যুদ্ধের সঙ্গে ঘোড়ার সম্পর্ক তো রয়েইছে। সেই কারণেই এখানে দেবীর বাহন ঘোটকমুখী। আজও রাজবাড়িতে একচালায় যোদ্ধা দেবীর পুজো হয়। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির প্রতিমা রাজরাজেশ্বরীর বেশে কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হল দেবী এখানে যোদ্ধার সাজে সেজে ওঠেন। বর্ম পরিহিতা দেবী। দেবীর বাহন পৌরাণিক সিংহ অর্থাৎ ঘোড়ামুখো সিংহ। বৈষ্ণব বাড়ির দুর্গার বাহন হয় ঘোটকমুখী সিংহ। দুর্গার বাহনের মুখাবয়ব নিয়ে আরও এক কিংবদন্তির কথা শোনা যায়।
বারোয়ারি দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে একবার চুঁচুড়ায় বিস্তর ঝামেলার সৃষ্টি হয়েছিল। চুঁচুড়ায় প্রথম বারোয়ারি দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল ১৮২৬ সালে। বারোয়ারি পুজোয় দেবীকে শাক্ত না বৈষ্ণব, কোন পদ্ধতিতে পুজো করা হবে, তা নিয়ে মতবিরোধের সৃষ্টি হয়েছিল। ঝামেল চলল। শেষে পণ্ডিতরা বিধান দিলেন, একই মূর্তিকে একবার বৈষ্ণব আর একবার শাক্ত মতে পুজো করা হবে। তাই হল। কিন্তু বিসর্জনের সময় ফের বাঁধল গন্ডগোল। বৈষ্ণবরা বলল, তারা ঘট বিসর্জন দিয়েই দিয়েছে; আবার প্রতিমা বিসর্জনের খরচ কেন দিতে যাবে? গন্ডগোল চরমে উঠল। পরের বছর থেকেই দুর্গাপুজোয় শাক্ত আর বৈষ্ণবদের দুর্গামূর্তি আলাদা হয়ে গেল। শাক্তের সিংহ হল সাধারণ সিংহের ন্যায় আর বৈষ্ণবরা ঘোড়ামুখো সিংহ গড়তে শুরু করল।
ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানের প্রত্নতাত্তিক খননে মাটির তলা থেকে যে সব দুর্গা মূর্তি পাওয়া গেছে তার মধ্যে মূর্তিতেই দেবীর বাহন সিংহ। মহিষমর্দিনী এবং সিংহবাহিনী; দুই রূপের মধ্যে মহিষমর্দিনী রূপটিই প্রাচীন, মনে করা হয় সপ্তম শতাব্দী থেকে সিংহসহ মহিষমর্দিনী মূর্তি এসেছে। বুদ্ধযুগ থেকে হিন্দুযুগের দিকে এগোনোর সময় মহিষমর্দিনী মূর্তি আস্তে আস্তে সিংহবাহিনী হয়ে উঠেছে। প্রাচীন বঙ্গে বহু পরিবারের কূলদেবী ছিলেন মা সিংহবাহিনী।