গ্রামে জল বসন্ত দেখা দিলে পুজো গ্রহণ করেন না এই দেবী

ঝাড়গ্রামের জামবনী অঞ্চলের অনেক লৌকিক দেব-দেবী পুজোর প্রচলন রয়েছে। মা ল্যাকল্যাকান তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঝাড়গ্রামের আদিবাসী সম্প্রদায়ের সব্বর পরিবারের লোকেরা এই দেবীকে বংশপরম্পরায় পুজো করে আসছেন। এই পুজোর বয়স ১০০ বছর অথবা তার থেকে কিছুটা বেশি। সাধন সব্বর বর্তমানে এই দেবীর পুজোর দায়িত্বে রয়েছেন। ঝাড়গ্রামের এই লৌকিক দেবী একেবারে ওই অঞ্চলের মানুষের আপনজন। এখানে মা সিংহবাহিনী। এই সিংহবাহিনী দেবী দ্বিভূজা। তবে ঠাকুরের প্রতিকৃতিটি এক হাতে একটি ধারালো তলোয়ার ধরে রয়েছেন। দেবী মা মাটির হাতি ঘোড়ার ছলন মূর্তিকে সঙ্গে রাখেন। একটি জঙ্গলের মধ্যে এই মায়ের থান রয়েছে।

এই দেবীর থানে নিত্য পুজোর চল নেই। বছরে মোট চারবার পুজো করা হয়। জ্যৈষ্ঠ মাস, আষাঢ় মাস, অগ্রহায়ণ এবং মাঘ মাস। গ্রামে কারোর পক্স বা মায়ের দয়া হলে ওই সময় পুজো বন্ধ থাকে। এই মায়ের থান জঙ্গল ও সবুজ গাছ দিয়ে ভরা। একটি পিলারের প্রতিকী ভগ্নাংশের ওপর মায়ের মূর্তিটি খোদাই করা রয়েছে। সামনে রয়েছে একটি বিশাল আকারের পুকুর। কথিত আছে এই পুকুরের জল ছাড়া মায়ের পুজো হয় না। পুজোর আগে সব্বর পরিবারের কেউ গিয়ে বড়পুকুর থেকে জল তুলে নিয়ে আসেন। তারপর পূজারী বসেন পুজোয়। এই জলে স্নান করিয়ে চাঁদমালা পরানো হয় মাকে।

বড় পুকুরের জল দিয়ে মা ল্যাকল্যাকানকে স্নান করানো হয়। ফলমূল, বাতাসা, চিড়েগুড়, বেলপাতা, সিঁদুর, ধূপ থানের সামনে সাজিয়ে পূজারী পুজো শুরু করেন। পুজোয় কোনও মন্ত্র পাঠ করা হয় না। যে যার মনের মনস্কামনা ঠাকুরকে নিজেদের মৌখিক কথ্য ভাষায় জানান। এখানে স্থানীয় মানুষরা নিজেদের মনের কথা মাকে জানান এবং মানত করেন। মা ল্যাকল্যাকানের কাছে মানত করে পোড়া মাটির হাতি, ঘোড়া দেওয়ার রীতি রয়েছে। পুজোর পর ভক্তরা প্রসাদ হিসেবে চিড়ে এবং গুড় পান। একেবারে লৌকিক এই পুজোয় অনেকেই মনে করেন মায়ের প্রতিকৃতি খোদাই করা পিলারের ভগ্নাংশটা আসলে বীরস্তম্ভ। আগে সৈন্যরা যুদ্ধে মারা গেলে তাদের বীরত্বের বলিদানকে স্মরণ করে ‘সান স্টোন’ দিয়ে তৈরি করা হতো ফলক। এই ফলকগুলোকে বলা হয় হিরোস্টোন বা বীরস্তম্ভ। বাঁকুড়া ও বীরভূম জেলার একাধিক জায়গায় এমন স্তম্ভ পাওয়া গেছে যা পরবর্তীকালে লৌকিক দেবদেবী হিসেবে পুজিত হন। অনেক ঐতিহাসিক বলেন মা ল্যাকল্যাকানের প্রতিকী পিলাটি আসলে একটি হিরো স্টোন বা বীরস্তম্ভ। অনেক ঐতিহাসিক আবার এই তথ্যটি অস্বীকারও করেন।।

রাঢ় অঞ্চলের বেশিরভাগ থানেই হাতি-ঘোড়ার ছলন মূর্তি দেওয়ার চল রয়েছে। আসলে ঘোড়া হলো তেজ আর শক্তির প্রতীক। বহুদিন আগে থেকেই মানুষ এই তেজ, ক্ষিপ্ততা আর শক্তিলাভের প্রতীক হিসেবে ঈশ্বরের স্থানে পোড়া মাটির ঘোড়া দান করে আসছেন। তবে এইসব লৌকিক দেব-দেবতারা আসলে ওই অঞ্চলের মানুষের একেবারে আপনজন অর্থাৎ কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন খুব সহজেই।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...