ভৃগুবংশের এক ব্রাহ্মণ ছিলেন শিবের দারুণ ভক্ত। একদিন তিনি ভাবলেন, জান্তে-অজান্তে কত পাপই তো হয়ে যায় জীবনে! শরীরে সেই পাপ নিয়ে তো আর শিবের চরণে ঠাঁই পাওয়া যাবে না! তাই তপস্যার মধ্য দিয়ে সেই সমস্ত পাপ নষ্ট করে তিনি একেবারে পবিত্র হয়ে শিবপ্রিয় হবেন। কাজেই শুরু করলেন তপস্যা।
সে এক দেখার মতো তপস্যা, শেখার মতো সাধনা। বর্ষার তীক্ষ্ণধারায়, প্রখর গ্রীষ্মে সূর্যকে মাথায় রেখে চারপাশে আগুন জ্বেলে, শীতে বরফ-শীতল জলে বসে দারুণ কৃচ্ছ্রসাধনা শুরু করলেন। শুধু তাই নয়, খিদেতেষ্টা উপেক্ষা করলেন; তপের আসন ছেড়ে কিছুতেই উঠলেন না। তাঁর সেই ত্যাগ দেখে বনের হিংস্র পশুরাও হিংসা ভুলে গেল। তারা হয়ে উঠল তাঁর পরম বন্ধু। তারা বনের ফল মুখে করে এনে প্রতিদিন ব্রাহ্মণকে খাওয়াতে লাগল। কৃচ্ছ্রসাধনা করতে করতে এরপর ফল খাওয়া ছেড়ে তিনি শুরু করলেন গাছের ঝরা পাতা খেতে। গাছের ঝরা পাতাকে বলে, 'পর্ণপত্র'। তাই দেবতারা পর্ণভুক এই ব্রাহ্মণের নাম দিলেন, 'পর্ণাদ'। এমনি করে কেটে গেল বহুবছর।
তপস্যাস্থলের কাছে নিষ্ফলা জমি, সেখানে একদিন যজ্ঞের জন্য পর্ণাদ কুশ সংগ্রহ করছিলেন। মুহূর্তের অসাবধানতায় পর্ণাদের ডান হাতের মধ্যমা কেটে গেল। আর তা থেকে বেরুতে লাগল রক্তের বদলে শাকের রসের মতো অবিকল সবুজাভ রস। তাই দেখে আনন্দে অধীর হয়ে উঠলেন তিনি। এটাই তো তিনি চাইছিলেন! দীর্ঘ তপস্যার মধ্য দিয়ে তিনি জানতে পেরেছিলেন, যেদিন তাঁর রক্ত শাকের রসের মতো হয়ে উঠবে, সেদিনই তিনি হয়ে উঠবেন নিষ্পাপ-নিষ্কলুষ এক মানুষ। তিনি এখন জগতের পবিত্রতম প্রাণি! আনন্দের চোটে তাঁর মনে অহং এল, সেই অহং-এর বশে তিনি হুঙ্কার ছেড়ে নাচতে শুরু করলেন। সময় বয়ে গেল, তবু তাঁর সেই পাগলপারা নাচ কিছুতেই থামল না!
ইতিমধ্যে বন্ধু পশুরা পর্ণাদের সঙ্গে দেখা করতে এসে তাঁর এই পাগলামো আর ভয়ানক গর্জন শুনে ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল। নিজেকে নিয়ে বিভোর পর্ণাদ তাদের দিকে ফিরেও দেখলেন না। অহংমত্ত পর্ণাদ বুঝতেও পারলেন না যে, তিনি আবার পাপের পথে এগিয়ে চলেছেন!
পরমভক্তকে এই পতনের পথে নামতে দেখে শিব আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি ব্রাহ্মণের বেশে মর্তে নেমে দূর থেকেই পর্ণাদের নাম ধরে হাঁকডাক করতে করতে এগিয়ে এলেন। কিন্তু, তাঁর কথা মত্ত পর্ণাদ শুনতেই পেলেন না। ব্রাহ্মণ কাছে এলেন। তাঁর চোখে চোখ পড়তেই পর্ণাদ হঠাৎ স্থির হয়ে গেলেন। তখন স্মিত হেসে ব্রাহ্মণরূপী শিব তাঁকে বললেন, 'ওহে পর্ণাদ, এ তুমি কী করছ! এই চরাচরে তুমি তো একা নও, তোমার চেয়েও সহস্রগুণসিদ্ধ ভক্ত রয়েছেন; তবুও তুমি নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভেবে বসলে! ভুলে গেলে অহংকারই পতনের মূল! তোমার রক্ত তো সবে শাকের রসের রূপ নিয়েছে, আমার রক্ত কেমন জানো?' বলতে বলতে শিব কড়ে আঙুলের নখ দিয়ে ডান হাতের মধ্যমা চিরে ফেললেন। আর কী আশ্চর্য, তা থেকে ঝরে পড়তে লাগল অঝোর ধারায় সাদা ছাই, বিভূতি! পর্ণাদ অবাক হয়ে দেখলেন, আগন্তুক ব্রাহ্মণের সারা গায়ে দ্রুত ফুটে উঠছে বিভূতিচিহ্ন! তাই দেখে হঠাতই তাঁর যেন বোধদয় হল, অহং-এর পর্দা সরে খুলে গেল জ্ঞানের চোখ। তিনি কাঁদতে কাঁদতে পায়ে পড়লেন সেই ব্রাহ্মণের। বললেন, 'আপনি সামান্য ব্রাহ্মণ নন, আমায় কৃপা করুন! হে প্রভু, আমার অন্তর বলছে, আপনি ভক্তবাঞ্ছা কল্পতরু মহাদেব। প্রভু, স্বরূপে দর্শন দিয়ে আমায় কৃপা করুন, আমায় পথ দেখিয়ে ধন্য করুন!'
পর্ণাদের আকুলতায় শিব তুষ্ট হলেন। দর্শন দিলেন আপন স্বরূপে। তারপর পর্ণাদকে বুঝিয়ে দিলেন বিভূতি মাহাত্ম্য। বললেন যে, এই বিভূতি যে-ভক্ত শরীরে ধারণ করেন, বিভূতিতে অবগাহন করেন; তিনি সমস্ত তীর্থ ও পুণ্যসলিলে অবগাহন করার পুণ্য অর্জন করে হয়ে ওঠেন কলুষহীন পবিত্র। তিনি ঠাঁই পান তাঁর পরম চরণে।
শিব কথিত এই 'অবগাহন'-এর অন্য একটি মানে আছে। সেটা এবার বলি। আসলে এই যে বিভূতি, এ তো সাধারণ ছাই নয়, এ হল শরীরের সমস্ত পাপের মূলে যে অহং, সেই অহংপোড়া ছাই। হিন্দুশাস্ত্রে অপার্থিব দেহকে পোড়ানো বা দাহকর্মের এক নাম, 'সৎকার' বা 'সৎকাজ'। তাই শিবপ্রিয় হয়ে উঠতে গেলে অহংকে মৃতদেহের মতোই দাহ করার সাধনা করতে হবে। অবগাহনে শরীর যেমন নির্মল হয়ে ওঠে, তেমনি একবার অহং দাহ করতে পারলে তাতে আত্মা অবগাহন করে নির্মল ও পবিত্র হয়ে ওঠে। তখন আর কোন তীর্থ করার প্রয়োজন পড়ে না, তখন সেই আত্মার আধার এই দেহই হয়ে ওঠে নিষ্কাম এক তীর্থ। যুগে যুগে ভক্তদের এ-কথা মনে করিয়ে দিতেই শিব সেই পর্ণাদের কাল থেকে অঙ্গে ধারণ করে রয়েছেন বিভূতি বা ছাই। বিভূতিকে করে তুলেছেন আপন অঙ্গের ভূষণ। তাই তাঁর আর এক নাম, 'বিভূতিভূষণ'। শিবভক্ত নাগাসম্প্রদায়ও আরাধ্য শিবের এই শিক্ষা স্মরণে রাখতেই নিজেদের শরীরে লেপন করে থাকেন শিবের নামে বিভূতি অর্থাৎ পার্থিব ছাই।
গল্পের উৎস : শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ণ বেদব্যাস রচিত, 'শিব পুরাণ'।