স্বপ্ন রহস্য

মানুষ চিরকালই কৌতূহল প্রিয় জীব। তাই সে বরাবরই রহস্য সন্ধানী। আবার মানব জীবনের সবথেকে রহস্যময় বিষয়টি হল স্বপ্ন দেখা। আমরা কম-বেশি সকলেই স্বপ্ন দেখে থাকি। মনে করা হয় চেতন অবস্থায় যা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না অবচেতনে স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে মানুষ তার সেই সুপ্ত বাসনা পূর্ণ করে থাকে। কখনও  এই স্বপ্ন হয় সাত রাঙা রামধনুর মতন রঙিন। আবার কখনো তা হয়ে ওঠে রাতের অন্ধকারের মতন গাঢ়। স্বপ্ন দেখে অনেক সময় আমরা ঘুমের মধ্যে হেসে উঠি আবার স্বপ্নের মধ্যে যখন কোন দূর্ঘটনা অবলোকন করি তৎক্ষনাৎ আমাদের চেতনা কিছু সময়ের জন্য থেমে যায়। এভাবেই আমরা স্বপ্ন দেখে থাকি। আমরা সাধারণত স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে অন্বেষণ করার চেষ্টা করি অবচেতনার আশ্চর্য জগতকে।

বিশ্বের সর্বত্র স্বপ্ন নিয়ে রয়েছে নানা জিজ্ঞাসা। শুধু তাই নয় ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যাবে বহু রাজ-রাজা, মনিষী ও বিখ্যাত মানুষেরা স্বপ্ন দ্বারা তাড়িত হয়ে এমন কিছু কাজ করেছেন যার পরিণাম হয়েছে সুখ সমৃদ্ধি অথবা বিধ্বংসী অন্ধকার। এ প্রসঙ্গে উল্ল্যেখযোগ্য হল চিতোরের রাজা লক্ষ্মন সিং’ –এর কাহিনী। শোনা যায় লক্ষ্মন সিং স্বপ্নে তাঁর আরাধ্য দেবীকে দেখেন, এবং তার আরাধ্য দেবী স্বপ্নে তাঁকে আদেশ দেন শীঘ্র মুঘল আক্রমন করতে। এই স্বপ্ন দেখার পরেই তিনি সেই সময়কার মুঘল বাদশা ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।

মনোবিজ্ঞান নানা ভাবে স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়েছে তবে স্বপ্ন নিয়ে রহস্যের ধোঁয়াশা আজও বর্তমান। এই আলোচনায় স্বপ্ন সম্পর্কে কিছু তথ্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করা হল। স্বপ্নের মধ্যে আমরা এক অদ্ভুত জগতে পা রাখি। যেখানে গিয়ে আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা প্রবল আশা-আকাঙ্খা গুলির বাস্তবায়ন হয়ে থাকে। স্বপ্ন সাধারণত দুটি ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। দিবা স্বপ্ন বলতে আমরা দিনের বেলায় অবচেতনে যে স্বপ্ন দেখি তাকে বোঝায়। সেই সময় আমাদের শরীর অনেকটাই কর্ম চঞ্চল থাকে। অল্প বয়স্ক বা কিশোর-কিশোরীরা এই ধরণের স্বপ্ন বেশি দেখে থাকে। তাদের মন জুড়ে যে ইচ্ছার বিকাশ ঘটে তারই প্রতিফলন এই দিবা স্বপ্ন। গবেষণায় দেখা গেছে স্বপ্নের সাথে যে স্বপ্ন দেখছে তার মানসিক অবস্থান অনেকটা সম্পর্কযুক্ত। যেমন- একজন দৃঢ়চেতা মনের কিশোরকিশোরী সাধারণত ফুরফুরে বা নীল আকাশের মতন রঙিন স্বপ্ন দেখে থাকে পক্ষান্তরে হঠকারী বা চিন্তাশীল মনোভাবাপন্ন কিশোরকিশোরীরা জটিল স্বপ্ন দেখে থাকে।

রাতে স্বপ্ন দেখলে তার গভীরতা হয় অনেক বেশি। রাতের স্বপ্নের মধ্যে বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন আমদের পরিচিত কোনও  মানুষ বা পরিবেশ সম্পূর্ণ বদলে যায়। আবার যতক্ষন কোন স্বপ্ন দেখি সেই স্বপ্নের ঘটনাকে বাস্তব বলেই মনে হয়। অনেক সময় স্বপ্নে কোনও  ব্যাক্তিকে দেখলে তার মুখমন্ডল দেখতে পাওয়া যায় না। দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ ঘটনাগুলি প্রতীক বা পর্দার আড়ালে আচ্ছাদিত থাকে যা স্বপ্নের আকারে ঘুমের মধ্যে ভেসে ওঠে।

মনোবিজ্ঞানীরা স্বপ্ন নিয়ে বহু ভিন্ন ভিন্ন মতবাদ পোষণ করেছেন। অস্ট্রিয় মনস্তাত্ত্বিক সিগমুন্ড ফ্রয়েড বরাবর স্বপ্ন নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করে গেছেন। তাঁর মতে স্বপ্ন হল আমাদের মনের অবদমিত ইচ্ছা বা আকাঙ্খার প্রতিফলন। জেগে থাকা অবস্থায় আমরা যে সত্যিকে মুষ্ঠিবদ্ধ করতে পারি না তার উপস্থিতি ঘটে স্বপ্নের মাধ্যমে। স্বপ্নের সাথে মানুষের বংশ ও ভবিষ্যৎ ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। ফ্রয়েডের এই স্বপ্ন তত্ত্ব থেকে অনেক কথাই বলা যেতে পারে। যেমন ফ্রয়েড একটি পরীক্ষার দ্বারা প্রমান করেন যে প্রাপ্ত বয়স্করা যে স্বপ্ন দেখে তার মধ্যে টাকা-পয়সার স্বপ্নই বেশি। প্রাপ্ত বয়স্কদের অর্থলোলুপ মনোভাবের কারণে এই স্বপ্ন দেখা।

আবার কখনও দেখা যায় স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে ভবিষ্যতকে দেখা। আদৌ কী তা হয়? এরকম অনেক প্রশ্ন আমাদের মনে আসলেও উত্তর পাওয়া যায় না। তবে বেশ কিছু ঘটনা আছে যেগুলি পড়লে জানা যাবে স্বপ্নের দ্বারা ভবিষ্যতের আগাম বার্তা প্রেরিত হয়। এ প্রসঙ্গে আরো একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কথা বলা যায়। চার্লস ডিকেন্স এর নাম আমরা সকলেই জানি। ইংরাজি সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক তিনি। তিনি তাঁর একটি স্বপ্নের ব্যাখ্যায় বলেছিলেন – তিনি প্রায়শই তাঁর স্বপ্নে লাল রঙের শাল পরিহিতা এক রমনীকে দেখতেন। সেই রমণী নিজেকে মিস নেপিয়ান বলে পরিচয় দিতেন। কিন্তু ডিকেন্স কখনই সেই রমনীর মুখমন্ডল দেখতে পারেননি স্বপ্নে। তার কিছু দিন পরে ঠিক হুবহু লাল শাল পরিহিতা এক রমনীর সাথে তাঁর পরিচয় হয়, এবং আশ্চর্য ভাবে ওই রমনী নিজের পরিচয় জানান মিস নেপিয়ান। এই ঘটনার পর ডিকেন্স অবাক হয়ে যান। কিন্তু এই স্বপ্ন রহস্য সকলের অজানা।

এরপর আসা যাক ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার ডানের কথায়। তিনি তাঁর স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে ভবিষ্যতের ট্রেন দুর্ঘটনাকে দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁর স্বপ্নের কয়েক মাস পরেই এপ্রিল মাসে সেই ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছিল। ডানে এই ভয়ঙ্কর ট্রেন দুর্ঘটনার আভাস পূর্বেই পেয়েছিলেন স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে।

আবার বলকান প্রদেশের বিশপ মঁসিয়ে যোশেফ দেলাভির কাহিনীও এক্ষেত্রে বেশ প্রাসঙ্গিক। ১৯১৪ সালের জুন মাসে দেলাভি তাঁর স্বপ্নে একটি চিঠি পান। সেই চিঠিতে আর্চ ডিউক ফার্দিনান্দ লিখেছিলেন আমি এবং আমার স্ত্রী রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার শিকার হলাম। ঠিক তার পরের দিন ঐ বিশপ সংবাদ পেলেন আর্চ ডিউক ফার্দিনান্দকে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু দিনের মধ্যেই প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পথ উন্মোচন হয়েছিল।

উক্ত বিষয়গুলি শুনলে বা পড়লে অনেক রহস্যই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তবে স্বপ্ন সত্যি সত্যিই সুদূর ভবিষ্যৎকে আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরে, না এগুলি শুধুই মানব মনের কল্পনার প্রতিচ্ছবি তা রহস্য হিসেবেই থেকে গেছে।       

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...