দুগ্গা কথা: মুর্শিদাবাদের রায়চৌধুরী বাড়ির বুড়িমার দুর্গা পুজো

পঞ্জিকা বলছে শ্রাবণ মাস চলছে, আশ্বিন আসন্ন। দরজায় কড়া নাড়ছে দুর্গা পুজো। এই পুজো আসছে শব্দটাই বাঙালিদের কাছে যথেষ্ট। শরৎ এলেই পুজো আসে। শিউলি ও কাশফুল আর সন্ধ্যে বেলার ছাতিমের গন্ধ জানান দেয় উমার আগমনীবার্তা। আজ থেকে আমরা দুগ্গা কথা শুরু করছি। নানান রূপে দেবী দুর্গা পূজিত হন, কোথাও দেবী মহামায়া রূপে, কোথাও বা দেবী অভয়া রূপে। আবার বনেদি বাড়ির পুজো এক রকম, গ্রামের পুজো অন্য রকম আবার বারোয়ারি পুজোর স্বাদ একেবারেই আলাদা। আজ মুর্শিদাবাদের নবগ্রাম থানার পশলা গ্রামে রায়চৌধুরী জমিদার বাড়ির পুজোর কথা নিয়ে আলোচনা হবে। তবে এখানে মা দশভূজা নন, তিনি চতুর্ভূজা। রায়চৌধুরী বাড়ির দুর্গা পুজোর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, এদের বাড়ির পুজোয় একই মণ্ডপের ছাদের নীচে তিনটি বেদিতে তিনটি দুর্গার আরাধনা করা হয়।

উমা চতুর্ভূজা, দেবী মূর্তিতে তিনি ব্যাঘ্রবাহিনী হয়ে অসুর নিধন করছেন। প্রতি বছর রথের দিন নবগ্রামের পাশলা গ্রামের রায়চৌধুরী জমিদার বাড়ির দুর্গার প্রতিমার কাঠামোয় পুজো করে, মাটির প্রলেপ দিয়ে প্রতিমা গড়ার কাজ শুরু হয়। রায়চৌধুরী বাড়ির দুর্গা দশভূজা নন। ব্যাঘ্ররুপী সিংহের উপর দেবী অধিষ্ঠাত্রী, চতুর্ভূজা দেবী অসুর নিধন করছেন। বাড়ির দুর্গা মণ্ডপের ছাদের তলায় প্রতিমা গড়ার কাজ চলে। ষষ্ঠীর দিন সকালে তিনটি প্রতিমাকে তিনটি বেদীতে স্থাপন করা হয়। এরপর গ্রামের পুকুর থেকে তিনজন পুরোহিত তিনটি ঘট ভরে তিন দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেন। বাজতে থাকে ঢাক। রায়চৌধুরী বাড়ির পুজোয় অন্নভোগ হয় না। লুচি, ফল ও মিষ্টান্ন সহযোগে তিন দেবীকে ভোগ নিবেদন করা হয়। ষষ্ঠী, সপ্তমী, সন্ধিপুজো এবং নবমীতে ছাগবলি হয়। 

গোটা গ্রামের মানুষ রায়চৌধুরী বাড়ির এই দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে মেতে ওঠেন। এই পুজোও রায়চৌধুরী জমিদার বাড়ির পুজো হিসেবেই পরিচিত পেয়েছে। এই পুজো রায়চৌধুরী পরিবারের পুজো বলে পরিচিতি পেলেও, রায়চৌধুরী পরিবারের কোন পূর্বপুরুষ কিন্তু এই পুজো শুরু করেননি। জনশ্রুতি থেকে যায়, এখন যেখানে পুজো মণ্ডপ রয়েছে, সেখানে আগে জঙ্গলে ঘেরা উঁচু ঢিবি ছিল। আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিনশ বছর আগে, এক সন্ন্যাসিনী এই গ্রামে আসেন এবং জঙ্গলে ঘেরা উঁচু ঢিবিতে পঞ্চমুন্ডির আসন স্থাপন করেন। সেখানেই সাধনা করতে আরম্ভ করেন ওই সন্ন্যাসিনী। সিদ্ধিলাভও করেন। এরপর সিদ্ধ সন্ন্যাসিনী পঞ্চমুন্ডির আসনে ঘট স্থাপন করে দশভূজার আরাধনায় ব্রতী হন। বৃদ্ধা সন্ন্যাসিনীকে গ্রামবাসীরা সকলেই বুড়িমা বলে ডাকতেন। সেই বুড়িমা অর্থাৎ সন্ন্যাসিনীর প্রতিষ্ঠিত এবং পূজিত দুর্গা তখন থেকেই বুড়িমা নামে পরিচিতি লাভ করে। 

সন্ন্যাসিনীর মৃত্যুর পরে, পাশলার জমিদার মথুরানাথ রায়চৌধুরী এই পুজোর দায়িত্ব নেন। কথিত আছে, সন্ন্যাসিনীর নির্দেশেই তিনি পুজো চালিয়ে যেতে থাকেন। সেই সময়ে ঘট পুজো হত, এখনকার মতো মূর্তি পুজো হত না। শোনা যায়, পরবর্তীতে কোন এক সময়ে জমিদার পরিবারের এক সদস্যকে মূর্তি গড়ে দেবী দুর্গার পুজো করার আদেশ দেন বুড়িমা। সেই থেকেই মূর্তিতে পুজো শুরু হয়। বেশ কয়েক বছর পরে পুজোর স্বত্বাধিকার নিয়ে জমিদার পরিবারের দুই শরিক গিরিশ রায়চৌধুরী ও শ্রীশচন্দ্র রায়চৌধুরীর মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়, সেই থেকেই দুজনে একই দুর্গামণ্ডপের ছাদের নিচে মূল বেদীর ডান দিকে আরও দুটি বেদী নির্মাণ করেন এবং সেখানে দুর্গা পুজো শুরু করেন। এইভাবেই রায়চৌধুরী বাড়িতে তিন দেবীর পুজো আরাধনা শুরু। পঞ্চমুণ্ডি আসনে অধিষ্ঠিত বুড়িমাকে শর্মার সাজ এবং অন্য দুই দেবীকে শোলার সাজ পরানো হয়। 

রায়চৌধুরী পরিবারের পুজোর ঐতিহ্য হল এখানে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল ধর্মের মানুষ পুজো মণ্ডপে আসেন। পুজোয় অংশ নেন, এবং প্রসাদ গ্রহণ করেন। সপ্তমীর দিন ভোরে নবপত্রিকা স্নান করিয়ে ঘটস্থাপনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সপ্তমী পুজো। লুচি, পাঁচরকম ভাজা, তরকারি ও শাক দিয়ে মাকে ভোগ নিবেদন করা হয়। অষ্টমীর ভোগে দেওয়া হয় সুজির হালুয়া, লুচি, ভাজা, শাক, তরকারি। আখও উৎসর্গ করা হয়। সন্ধিপুজোয় সুজির হালুয়া, লুচি, মালপোয়া, মিষ্টি, কুমড়ো উৎসর্গ হয়। নবমীর পুজো শেষে গ্রামবাসী ও দর্শনার্থীদের মধ্যে খিচুড়ি বিতরণ করা হয়। দশমীর সকালে সিঁদুর খেলা হয়। জমিদার পরিবারের মহিলাদের সঙ্গে গ্রামের মহিলারাও সিঁদুর খেলায় সামিল দেন। ওইদিন বিকেলে গ্রামে জমিদার পরিবারের দীঘিতে তিনটি দুর্গাকে ঢাকঢোল সহযোগে বিদায় জানানো হয়। শতাব্দী প্রাচীন এই পুজো আজও চলে আসছে। মুর্শিদাবাদ জেলার অন্যতম প্রাচীন ও ইতিহাস প্রসিদ্ধ এই পুজো, সেই জেলা তথা বাংলার ঐতিহ্যে সঙ্গে মিশে গিয়েছে। হয়ে উঠেছে অনন্য পুজো।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...