রাঢ়-বাঁকুড়ার সংস্কৃতিতে মুড়ি

খাব কী, বঞ্চনার গন্ধ পেয়ে পদ-ব্যঞ্জনের আঁতিপাঁতি হাতড়াতে শুরু করলাম। কিন্তু কই, একটাও তো মুড়ি পেলাম না! তার বদলে যা পেলাম, তা হল গুচ্ছের হুমদো হুমদো মাছের মুণ্ডুর টুকরো এবং টাকরা! তবু ভাই বলিহারি যাই, পদটির নাম নাকি 'মুড়িঘন্ট'! ঘন্টা! এ যে কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন! তাতে মুড়ি-ই যদি না দিবি, তার 'মুড়িঘন্ট' নাম দেওয়া কেন বাপু! শুধু 'ঘন্ট' দিলে কী হত? তাহলে যে, 'টাউটারি'টি হত না!-দাদা এবং দিদিভাইরা এ আমার নিকষ এবং সত্যি স্মৃতি।

সদ্য জ্ঞান হওয়া শৈশবে সেই পেথ্থমবার গাঁয়ের এক বিয়েবাড়িতে খেতে বসে 'মুড়িঘন্ট'-র নাম শুনে তাতে সত্যিই মুড়ি খুঁজতে বসেছিলাম! আর বড়রা হেব্বি ঢেঁকুর তুলে নির্দ্বিধায় সেই জালি পদটি খেয়ে হদ্দ হচ্ছে দেখে বেজায় হতাশ হয়েছিলাম! আসলে, তখন আমার জীবনে খাঁটি সরলতা ছিল, আমাদের জীবনে ছিল নির্ভেজাল মুড়ি।

হ্যাঁ, মুড়ি ছিল আমাদের বাঁকুড়ার জীবন-জিরেতের আষ্টপৃষ্ঠ জুড়ে। জুড়ে থাকার গল্পে আর একটু ছেলেবেলায় থাকি, কারণ সে-টুকুই যা সুখের। তা সেই ছেলেবেলায় জ্বরজারি হলেই তো রুচিফুচির একেবারে দফারফা হত। মুখ একেবারে হয় গোবর, নয়তো হত তেতো হালিম। কিচ্ছুটি খেতে ইচ্ছে করত না। বিছানায় শুয়ে প্রিয় খাঁজকাটা থিন এরারুটও চিবোতে ইচ্ছে করত না।

তখন মা ছোট্ট জামবাটিতে করে মেখে এনে দিত টাটকা গাওয়া ঘি মাখানো মুড়ি। আহা, মুখে দিয়ে আলতো চিবোলেই গলে গিয়ে যেন অমৃত হয়ে উঠত। তেতো শুকনো রসনা সরস হত। মাঝে মাঝে মা ঘিয়ের সঙ্গে সামান্য গোলমরিচের গুঁড়োও ছড়িয়ে দিত। বাঁকুড়ার মুড়ি এমনিতেই পরিমাণমতো নোনতা। ফলে, তাতে স্বাদের যে অপূর্ব বাহার হত, তা বলাই বাহুল্য। 

muri-body

জ্বরজারি না-হলেও আমরা ঘি এবং 'কোর' মাখানো মুড়ি খেতাম মাঝে মাঝে। বাড়িতে দুধের সর টকিয়ে-ফেটিয়ে ননি তৈরি করত মা। তারপর সেই ননি ছোট্ট কড়াইতে নিয়ে উনুনে বসিয়ে কষে গরম করলেই তৈরি হত ঘি। ঘিয়ের তলায় কড়াইতে ননির উদ্বৃত্ত যে অংশটি পড়ে থাকত, আগুনের তাতে তা মুচমুচে হয়ে যেত। তাকেই বলা হত, 'কোর'। এর স্বাদ হালকা টক টক। ওপরের ঘি অন্য পাত্রে ঢেলে নেওয়ার পর কড়ায়ের গায়ে লেগে থাকা ঘি এবং কোর কেঁচিয়ে মুড়িতে মাখিয়ে নিলেই নুন এবং টকে স্বাদ যা খোলতাই হত, কী আর বলব!

মুড়ি আমাদের কাছে ছিল যেন ছুটকো অসুখের টোটকা। কারও বমি বমি পাচ্ছে কিংবা বমি হচ্ছে অথবা হেগে মরছে, মুখ বিস্বাদ; দাও তাকে দেদার মুড়ির জল। গেলাসটাক জল ঢেলে চটকে-মটকে মুড়ি একেবারে গুঁড়ো করে ফেলতে হত, তারপর আধগুঁড়ো মুড়িগুলো ছেঁকে ফেলে দেওয়া হত। শেষে যে জলটি পড়ে থাকত তাতে স্বাদ মতো নুন এবং পছন্দ মতো লঙ্কা ঘষে খাইয়ে দেওয়া হত। কমঝম অসুখে এর চেয়ে ভালো ওষুধ আর ছিল না। তবে, বাড়াবাড়িতে ট্যাবলেট-বড়ি খেতেই হত। তখনও, মুড়ির জল একটা কাজ কিন্তু ভালো করত। নুন আর খাবারের অভাবে শরীরকে একেবারেই ঝিমিয়ে পড়তে দিত না। সেও বা কম কী।

তবে যাই বলুন, খোলায় গরম গরম মুড়ি ভাজা হচ্ছে; আর সেই মুড়ি থালায় থালায় খাওয়া হচ্ছে--এর চেয়ে স্বর্গীয় ব্যাপার হতেই পারে না। গরম মুড়ির স্বাদই আলাদা। তখন মাটির হাঁড়িতে মন্থনি ঘুরিয়ে ঘোল তৈরি করা হত সব বাড়িতেই। এই ঘোল তৈরির প্রক্রিয়াকে বলা হত, 'ঘোলমোয়া'। 'মন্থন' থেকে 'মোয়া'। তা সেই টক-মিষ্টি ঘোল কানা উঁচু থালায় নিয়ে তাতে গরম গরম মুড়ি মাখা হত। ঝোল ঝোল। তার সঙ্গে লম্বা একখানা কাঁচালঙ্কা মাঝে মাঝে চিবিয়ে খাওয়া অথবা থালায় ঘষে ঘষে খাওয়া। সঙ্গে ফালি করে কাটা শসা আর মূলো থাকলে তো কথাই নেই।

হাপুস হুপুস করে মুড়িটুকু খেয়ে তলানি যে ঘোলটুকু থাকত, সেটা চুমুক দিয়ে খেতে যা লাগত, তার কাছে রাবড়িও লাগত ফিকে। এই যে ঝোল ঝোল মেখে খাওয়া, সেটা আমাদের ভাষায় 'ছলছলে' করে খাওয়া। গরম বা ঠাণ্ডা দুধ অথবা দই কিংবা তেল ও আচার দিয়ে মেখেও এভাবে খাওয়া হত। এখনও হয়।

মুড়ি আমরা মেখেই খেতাম। এখনও খাই। একমাত্র চায়ের সঙ্গে চাখনা করে খেলে আমরা শুকনো মুড়ি খাই। এক গাল মুড়ি, এক চুমুক চা। চায়ে ভিজিয়ে খেলেও বেশ অন্যরকমের স্বাদ পাওয়া যায় মুড়ির।তবে, কঠোর কাজের কঠিন মূল্যে খেতে পাওয়া আমাদের জীবন। তাই কাজ করতে করতে খাওয়া আমাদের অভ্যেস নয়।

আর খাওয়ার পেছনে শিল্পিত-সময় কাটানোর ফুরসৎ আমাদের কোন কালেই ছিল না। শুকনো মুড়ি খেতে সময় লাগে বেশি, ভেজা মুড়ি অনেক অনেক কম সময়েই খাওয়া যায়। রুখাসুখা দেশের মানুষ আমরা একটু রসেবশে খেতেই ভালোবাসি। তাই মুড়ি  ভিজিয়ে এবং মেখে খাওয়াই আমাদের রীতি।

মুড়ি মাখতে চপ, সিঙ্গাড়া, কাঁচা টমেটো, পোড়া টমেটো, পোড়া বেগুন, কাঁচা সর্ষের তেল, গরম সর্ষের তেলে জিরে ও শুকনো লঙ্কার ফোড়ন, আমের আচার, লঙ্কার আচার, চানাচুর, টাটকা বা বাসি তরকারি, পান্তা ভাত-যে-কোন একটা হলেই হল। সঙ্গে কাঁচালঙ্কা, ফালি করে কাটা পেঁয়াজ-শসা-মূলো, যদি পাওয়া যায়।

তবে মাখাটা এমন হবে, যেন ঝোলও না-থাকে, আবার শুকনোও না-হয়। তাতেই মুড়ির স্বাদে মুক্তি। বেগুন পোড়া দিয়ে মাখা মুড়িতে সামান্য দুধ মেশালে স্বাদ আরও খোলতাই হয়। খিচুড়ি দিয়ে মাখা মুড়িও খেতে সুস্বাদু লাগে। তবে, পান্তা ভাতের সঙ্গে মুড়ি মেখে খেতে গিয়ে অনুখাদ্য (চাখনা) হিসেবে যদি চাট্টি ছাঁচি পেঁয়াজ পোড়া আর জিরে-লঙ্কার ফোড়নতেলে মাখা গরম গরম আলু পোড়া পাওয়া যায়, তাহলে আর কিচ্ছুটি লাগে না!

muri-body-1

মুড়িপ্রীতির দিক থেকে আমাদের অর্থাৎ বাঁকুড়াবাসীর সঙ্গে আর কারও তুলনা হয় না। ছোটবেলায় কোন জ্যাঠা এবং জাঁহাবাজ ছেলের ব্যাখ্যান করতাম আমরা এইভাবে: 'এইটুকু ছেল্যা তার আবার বাটি বাটি মুড়ি, সঙ্গে একটা বড় কাঁচালঙ্কা!' অর্থাৎ, ছেলেটির বড়দের মতো আস্পর্দার কাব্যিক ব্যাখ্যানেও মুড়ি বাদ দিইনি আমরা! কারণ, আমাদের অষ্টপ্রহরই মুড়ির প্রহর।

সকালে মুড়ি খাওয়া তো হয়ই, দুপুরেও কেউ কেউ ভাতের শেষে মুড়ি খান। বিকেলে মুড়ি খাওয়া হয়। রাত্রে রুটি খাওয়ার পর শেষ পাতে চাট্টি মুড়ি খাওয়া অনেকেরই অভ্যেস। তেল-ঘিয়ের তৈরি পিঠেপানা বা কোন মশলাদার খাবার খাওয়ার পর হজমি-হিসেবে মুড়ি খাওয়া হয়। এবং, তা সত্যি সত্যিই খুব কাজের। মুড়ি বদহজমের কোন অবকাশ রাখে না। এখানে একটা কথা বলি দাদা-দিদিরা, এই জীবনে এত এত মুড়ি খেয়েছি বটে, কিন্তু খেতের আলে বসে মুড়ি খাওয়ার মতো সুস্বাদ আর কোথাও পাইনি।

ছোটবেলার বর্ষার মাঠ। চাদ্দিক জলে থৈ থৈ। লাঙলে লাঙলে ভরা খেতের পর খেত। ধান লাগানোর প্রস্তুতি জোরকদমে। তারই মাঝে মুনিষ-মাহিন্দারদের জন্য ধুচুনিতে করে মুড়ি, শিশিতে সর্ষের তেল, কাঁচা লঙ্কা, পেঁয়াজ, শসা আর বালতি ভরা জল রোজ 'জলখাউকিবেলায়' অর্থাৎ সকালের জলখাবার সময় গোছ-ছাড়ানো কাদায় ছপাক ছপাক আওয়াজ তুলে পৌঁছে দিতে হত সেই জল ভরা মাঠে। মাঝমাঠে দাঁড়িয়ে আলগুলো যেন মনে হত এক একটি সুন্দরতম দ্বীপ। আর সেই দ্বীপে বসা মুনিষ-মাহিন্দারের গামছায় মুড়ি মাখার অপূর্ব গন্ধ যখন স্যাঁতস্যাঁতে বাতাসে ফেনিয়ে ফেনিয়ে উঠত, তেলে-জলে মুড়ি ভেজার বিজবিজে শব্দ উঠত; তখন তা জিভ সরস করে প্রায় পাগল করে তুলত। আর পারা যেত না। গলার গামছা খুলে মুড়ি মেখে মুখে দিতে জিভ যেন আর তর সইত না। 

মুড়ি শুধু আমাদের প্রিয় ও প্রাত্যহিক খাবারই নয়; অত্যন্ত শুভও। মা-মাসিরা মনে করতেন, এখনও করেন-পিঠেপানা খেয়ে যাত্রা করলে যাত্রা শুভ হয় না। তাই তাঁদের অমঙ্গল আশঙ্কা দূর করতে ভরপেট সে-সব খেয়েও চাট্টি মুড়ি 'শাস্তর' মুখে দিতেই হয়। আর ব্যাগে যদি পিঠেপানা নিয়ে যাওয়ার ব্যাপার থাকে, তাঁরা পিঠের প্যাকেটের ভেতর চার-পাঁচটি মুড়ি সঙ্গী হিসেবে দেবেনই দেবেন। নইলে নিয়ে যেতেই দেবেন না। হয়তো কোন এক কালে পিঠেপানা খেয়ে বা নিয়ে যাত্রাকালে কারও কোন অমঙ্গল হয়েছিল, তা থেকেই এই লোকসংস্কারটির জন্ম।

কিন্তু, খই বা চিঁড়েকে বাদ দিয়ে তার সঙ্গে নিছক মুড়ি-ই বা কী করে শুভ ও মঙ্গলজনক হয়ে উঠল, সেটাই বড় আশ্চর্যের! হয়তো সহজলভ্যতা ও প্রাত্যহিক-প্রীতির জায়গা থেকেই একদা শুভ হয়ে উঠেছিল। 

শুধু তাই নয়, মাটির ঘোড়ার জন্য বিখ্যাত পাঁচমুড়া গ্রামের কাছেই আর একটি গ্রাম, রাধানগর। সেই গ্রামে রয়েছে মদনমোহনের পুরনো মন্দির। এখানে মদনমোহনকে নিত্য পুজো করা হয় মুড়ির নৈবেদ্য দিয়ে। এছাড়াও বাঁকুড়ায় তো বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের বাস। তাদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই পারলৌকিকক্রিয়া ও অশৌচকালের বিভিন্নতা রয়েছে।

তবে, কোন কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে কেউ মারা গেলে দাহের পর এবং অশৌচ কাটানোর পর সন্ধ্যেবেলায় জ্ঞাতিগুষ্টিদের খই ও চিঁড়ের সঙ্গে মুড়ি খাওয়ানোর রীতি আছে।

উনুন-খোলা থেকে মেশিন, মুড়ি ভাজার রীতি বদলে গেছে। কিন্তু, বাঁকুড়াবাসীর মুড়িপ্রীতি এতটুকুও বদলায়নি। বিদেশি বা প্রাদেশিক ফাস্টফুডকে সে এক ইঞ্চিও জায়গা ছেড়ে দেয়নি। দেবেও না বোধহয়। কারণ, মুড়ির সঙ্গে বাঁকুড়াবাসীর যোগ যে একান্তই সাংস্কৃতিক ও আন্তরিক...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...