সময়টা ১৯২০। মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে সামিল হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। তাঁর সত্যাগ্রহ আন্দোলনেও বইছে প্রতিবাদের স্রোত। বারাণসী। মধ্যবয়স্ক এক লেখকের সাহিত্য সৃষ্টিতেও প্রভাব ফেলতে শুরু করলো গান্ধীজীর প্রতিবাদী ও সমাজ সংস্কারক আন্দোলনগুলো। ওই লেখকের সৃষ্টি জুড়ে থাকে নানান অনুভূতির মেলা। গান্ধীজির আন্দোলনের প্রভাবে সেখানে যোগ হলো সমাজ সংস্কারের ভাবনা। সামাজিক বৈষম্যকে মুছে ফেলার চেষ্টা। সমাজ গড়ার পথে মাইলস্টোন হয়ে রইল ওই সাহিত্যিকের সৃষ্টি এবং গান্ধীজীর চিন্তাধারার মেলবন্ধন। মুন্সী প্রেমচাঁদ। ৩১শে জুলাই, ১৮৮০। বারাণসীতে জন্ম তাঁর। বাবা ছিলেন পোস্ট অফিসের কেরানী। মা আনন্দী দেবীর জীবন তাঁর সাহিত্যচর্চার পথকে প্রজ্জ্বলিত করেছিল। তাঁর রচিত উপন্যাস "বড়ে ঘর কি বেটি"র আনন্দী চরিত্রটি তাঁর মায়ের দ্বারা অনুপ্রাণিত। মায়ের সঙ্গে তাঁর চতুর্থ সন্তান ধনপত রাই-এর অন্তরের বন্ধন ছিল দৃঢ়। তাই ধনপত রাই ওরফে মুন্সী প্রেমচাঁদের বেশিরভাগ গল্প, উপন্যাসে 'মা' চরিত্রটি প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁর লেখনীতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে মাতৃত্ব। মায়েদের অন্তরে লুকিয়ে থাকা ভালবাসার নুড়ি-পাথরের খোঁজ পাওয়া গেছে মুন্সী প্রেমচাঁদ এর সাহিত্যে।
মুন্সী প্রেমচাঁদের সৃষ্টির মূল উপজীব্য ছিল জীবনশৈলী। তাঁর কলমের ডগায় অনুভূতিদের মালা গাঁথা হত। আমাদের জীবনের প্রত্যেক অনুভূতির নানা রং থাকে। একেক রকম অনুভবএর গোড়ায় থাকে অভিজ্ঞতার পাঁচালী। সেই পাঁচালী দিয়েই সাজিয়েছিলেন তিনি তাঁর সাহিত্যকে। হিন্দি ভাষার ক্ষেত্রে তিনি 'উপন্যাস সম্রাট' হিসেবে পরিচিত। তাঁর সমস্ত সাহিত্য সৃষ্টি বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সমাদর পেয়েছে। সিনেমা, নাটক তৈরি হয়েছে সেই সমস্ত গল্প, উপন্যাস থেকে। অগুনতি পাঠক ও দর্শকদের হৃদয়ে পৌঁছেছে চরিত্রেরা। তাঁর সর্বাপেক্ষা চর্চিত সাহিত্য সৃষ্টি হল উপন্যাস 'গোদান'। মাত্র আট বছর বয়সেই তিনি মাতৃহারা হন। তাঁর বাবা দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন। সৎ মায়ের সঙ্গে সেভাবে অন্তরের যোগ গড়ে ওঠেনি। তবে মুন্সী প্রেমচাঁদের হৃদয় ছিল আকাশের মত। সৎ মায়ের প্রভাব এতটাই ছিল তাঁর জীবনে যে পরবর্তীকালে তাঁর অনেক রচনার মূল চরিত্র ছিলেন সৎ মায়েরাই। সেই মায়েদের হৃদয়ের কোটরে লুকিয়ে থাকা স্নেহ, ছদ্ম-রুক্ষতা, নিরাপত্তাহীনতা ছবির মত বর্ণনা করেছেন এই সাহিত্যিক।
তাঁর অন্তরে দেশপ্রেমের প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী ও তাঁর সমাজ সংস্কারমূলক আন্দোলন। মুন্সী প্রেমচাঁদ এর মনেও সঞ্চারিত হয় সমাজ সংস্কারের ধারণা। যার বেশির ভাগটাই ছিল গান্ধীজীর প্রভাবযুক্ত। জাতি-ধর্ম-বর্ণ এসব কিছুর ঊর্ধ্বে মানুষের গল্প বুনতে শুরু করেন তিনি। তাঁর কলমের অনুভূতির রঙের সঙ্গে মিশে যায় সমাজের নানান নিম্নতার প্রতিচ্ছবির রং। সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে নিজের সৃষ্টির মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এই লেখক। মূলত হিন্দি ভাষার লেখক হলেও সমস্ত ভাষাভাষী মানুষের হৃদয়ে পৌঁছতে পেরেছিলেন তিনি। আজ আমাদের সমাজ যেটুকু কুসংস্কার মুক্ত, নিম্ন চিন্তাভাবনা মুক্ত হতে পেরেছে তাঁর মূলে ছিলেন এই সকল লেখকেরা। এঁদের সৃষ্টি সমাজ গড়ার পাথেয়। মুন্সী প্রেমচাঁদ সাহিত্যজগতে তেমনই এক নক্ষত্র। ধ্রুবতারার মতো বৈষম্যমুক্ত সমাজের পথপ্রদর্শক। ৮ই অক্টোবর বারাণসীতেই মাত্র ৫৬ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তাঁর অমর সাহিত্যসৃষ্টি আজও পাঠকের অন্তরের অন্তঃপুরে শিকড় বিস্তার করে রয়েছে।