ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের চতুর্থী তিথিতে পালিত হয় গণেশ চতুর্থী। পুরাণ মতে এ দিনই গণেশের জন্ম হয়েছিল। ওই দিন থেকে ১০ দিন ধরে চলে গণেশের আরাধনা। গোটা দেশজুড়েই গণেশ সিদ্ধিদাতা রূপে পূজিত হন। কেউ তাঁকে গজানন বলে ডাকেন, আবার কেউ কেউ তাঁকে একদন্ত বলেন। ভারতবর্ষে এমনও মন্দির রয়েছে, যেখানে মস্তকহীন গণপতির পুজো করা হয়। ক্রোধে গণেশের মুণ্ডচ্ছেদ করেছিলেন মহাদেব। পরে সেই মুণ্ডহীন দেহে হাতির মাথা জুড়ে গণেশকে প্রাণ দান করা হয়েছিল। সেই থেকেই গণেশ গজানন অর্থাৎ তাঁর মুখ হাতির মতো। গণেশের এই রূপই যুগ যুগ ধরে পূজিত হয়ে আসছে। অষ্টবিনায়ক বলা হয়ে থাকে। গণেশ আটবার, আট রূপে তিনি দানব সংহার করেছিলেন।
অসুর জলন্ধরের সংহার করার জন্যে তার স্ত্রী বৃন্দার সতীত্ব ভঙ্গ করেন বিষ্ণু। এরপর জলন্ধরের এক পুত্র হয়, যার নাম কামাসুর। শিবের কঠোর তপস্যায় কামাসুর ত্রিলোক জয়ের আশীর্বাদ আদায় করে নেন। শিবের আশীর্বাদ পেয়েই দেবতাদের ওপর অত্যাচার শুরু করে কামাসুর। তখন সমস্ত দেবতারা গণেশের ধ্যান করেন। ময়ূরে সওয়ার হয়ে যুদ্ধ করতে আসেন গণপতি। কামাসুর পরাজিত হয়। কুবেরের লোভ থেকে জন্ম হয়েছিল দৈত্য লোভাসুরের। শুক্রাচার্য ছিলেন তার গুরু। শুক্রাচার্যের পরামর্শেই শিবের আশীর্বাদ লাভের জন্যে সাধনা করতে আরম্ভ করেন। লোভাসুরের সাধনায় শিব তুষ্ট হয়ে, তাকে নির্ভয় হওয়ার বরদান দেন। আশীর্বাদ লাভের পর লোভাসুর ত্রিলোক দখল করে। উদ্ধার পেতে সকলে গণেশের প্রার্থনা করেন। বিঘ্নহর্তা গজানন রূপে অবতার নেন গণেশ। যদিও শুক্রাচার্যের পরামর্শে লোভাসুর বিনা যুদ্ধেই পরাজয় স্বীকার করে।
আবার রাক্ষস ক্রোধাসুর সূর্যের তপস্যা করে বলিয়ান হয়ে ওঠেন, সূর্য ক্রোধাসুরকে সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড জয় করার আশীর্বাদ দিয়ে দেন। তারপরই শুরু হয় তান্ডবলীলা, আবার সবাই গণেশের শরণাপন্ন হন। লম্বোদর অবতার নেন গণেশ। ক্রোধাসুরকে গণেশ বোঝান ব্রহ্মাণ্ড জয় তার পক্ষে অসম্ভব। তারপরই ক্রোধাসুর চিরতরের জন্য পাতালে প্রবেশ করে। শিব ভক্ত মৎসরাসুরকে বধ করার জন্য বক্রতুণ্ড অবতার নেন গণেশ। শিবের আশীর্বাদে তিনি হয়ে ওঠেন নির্ভয়। মৎসরাসুরের দুটি পুত্র সন্তান ছিল। তারা দুজনই ছিল অত্যাচারী। মৎসরাসুর দেবতাদের উপর অত্যাচার করতে শুরু করে। তখন গণেশ বক্রতুণ্ড অবতার নিয়ে মৎসরাসুরকে ও তার দুই সন্তানকে বধ করেন। মহর্ষি চ্যবন তপোবলের মাধ্যমে মদের সৃষ্টি করেন, যে মহর্ষির পুত্র নামে পরিচিতি লাভ করে। দৈত্য গুরু শুক্রাচার্যের কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে দেবতাদের ওপর অত্যাচার করতে শুরু করে মদ। তখন সমস্ত দেবী-দেবতারা গণেশকে আহ্বান জানান। একদন্ত অবতার ধারণ করেন গণেশ মদাসুরকে যুদ্ধে পরাজিত করেন। দৈত্য গুরু শুক্রাচার্য মোহাসুর নামক অসুরকে দেবতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লড়ার জন্য প্রস্তুত করেন। অত্যাচারে ভীত দেবী-দেবতারা গণেশকে আহ্বান জানান। মহোদর অবতারে প্রকট হন গণপতি। মহোদরের অর্থ বড় মুষকে সওয়ার হয় মোহাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ অবতীর্ন হন মহোদর। বিনা যুদ্ধেই মহোদরকে নিজের ইষ্ট দেবতা স্বীকার করে নেয় মোহাসুর।
পার্বতী নিজের সখীর সঙ্গে কৈলাস পর্বতে ঘুর ছিলেন। সেই সময় কথাবার্তার মধ্যেই পার্বতীর হাসি থেকে বিশাল পুরুষের উৎপত্তি হয়। পার্বতী তাঁর নাম রাখেন মম। বনে তপ করতে যায় মম, সেখানে শংবাসুরের সংস্পর্শে আসেন মম। শংবাসুর মমকে দানবিক শক্তি প্রদান করে। এরপর মম গণেশকে প্রসন্ন করে ব্রহ্মাণ্ডে রাজত্ব করার আশীর্বাদ চেয়ে বসে। শুক্রাচার্য এ বিষয়ে জানতে পেরে মমকে দৈত্যরাজের আসন দেন। এরপর দেবতাদের ধরে কারাগৃহে বন্দি করতে শুরু করে মম। তখন গণেশকে আহ্বান করেন দেবতারা।বিঘ্নরাজ অবতারে গণেশ মমাসুরকে পরাজিত করে দেবতাদের বন্দিদশা থেকে মুক্ত করেন।
ব্রহ্মা সূর্যকে কর্মরাজ্যের অধিপতি করেন। রাজত্বকালে সূর্য একবার হেঁচে দেন, তা থেকে এক দৈত্য অহংয়ের উৎপত্তি হয়। সে দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের কাছে গিয়ে উপস্থিত হয়। শিক্ষা নেওয়ার পর থেকে সে অহন্তাসুর নামে পরিচিত হতে শুরু করে। নিজের রাজ্য তৈরি করার জন্যে দেবতাদের ওপর অহংতাসুর অত্যাচার শুরু করেন। তখনই ধূম্রবর্ণ অবতারে আবির্ভূত হন ধুঁয়োর মতো রঙ বিশিষ্ট বিশালাকৃতির গণেশ এবং অহন্তাসুরের বধ করেন।
এই অষ্টবিনায়ক এক বিশেষ মন্দিরের কথা আজ বলব। উত্তরাখণ্ডের সোনপ্রয়াগ থেকে তিন কিলোমিটার দূরত্বে কেদার যাওয়ার পথেই রয়েছে এক বিচিত্র মন্দির। সেই মন্দিরেই মুণ্ডহীন মূর্তিকে গণপতিরূপে পুজো করা হয়। স্থানীয়রা এই মন্দিরকে মুণ্ডকাটিয়া গণেশ মন্দির নামেই ডাকে। কেদারনাথ যাওয়ার পথে দর্শনার্থীরা এখানে পুজো দেন। মন্দিরের তলা দিয়ে বয়ে চলে মন্দাকিনী নদী। এই মন্দিরে মুণ্ডহীন গণেশ পুজোর নেপথ্যে রয়েছে এক কাহিনী। শিবপুরাণ অনুযায়ী, স্নানের সময় দেবী পার্বতী নিজ দেহ নিঃসৃত হলুদ দিয়ে একটি পুতুল গড়েন। ওই পুতুলেই প্রান সঞ্চার করে, নিজ পুত্ররূপে তাঁকে বরণ করেন দেবী পার্বতী।
গণেশের জন্মমুহূর্তে শিব সেখানে না থাকায়, গণেশের বিষয়ে কিছুই জানতেন না। একদিন দ্বাররক্ষক হিসেবে গণেশকে নিযুক্ত করে, স্নান করতে গেলেন পার্বতী। ঠিক সেই সময় সেখানে এসে উপস্থিত হন মহাদেব। অপরিচিত বালককে নিজের পথ থেকে সরে যেতে বলেন মহাদেব। কিন্তু মাতৃআজ্ঞা পালনে অনড় গণেশ কিছুতেই সরতে রাজি হননি। বরং সে পথ আগলে দাঁড়ায়। গণেশ তখন নিতান্ত বালক, দেবাদীদেবের সঙ্গে সে পারবে কেমন করে!
শিবের রোষে গণেশের পরিণাম হল মারাত্মক। ত্রিশুল দিয়ে গণেশ মস্তক ছেদ করলেন মহাদেব। স্নান সেরে ফিরেই মৃত গণেশকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন পার্বতী। মাতৃআজ্ঞা পালন করছিলে গণেশ, তা জানতে পেরেই মর্মাহত হলেন মহাদেব। প্রাণ ফিরিয়ে দিতে একটি উপায় বের করলেন মহাদেব। উত্তরদিকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে রয়েছে, এমন একটি শিশুর মস্তক কেটে আনার আদেশ করলেন শিব। নন্দী অনেক খুঁজে শেষমেশ একটি হস্তীশাবকের মস্তক সংগ্রহ করে আনলেন। সেই মস্তকই গণেশের দেহে স্থাপন করে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করলেন মহাদেব। বলা হয় উত্তরাখণ্ডের যে জায়গাতে প্রাণ ফিরে পেয়েছিলেন গণেশ, সেখানেই গড়ে উঠেছে মুণ্ডকাটিয়া গণেশ মন্দির। এই মন্দিরে আজও গণেশ আরাধনা চলে।
আবার অন্য একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী, শনির দৃষ্টিতে গণেশের মস্তক বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। সেই দেহ বিচ্ছিন্ন মস্তকটির কথা জানতে আমাদের মধ্যযুগীয় কাব্যে উঁকি দিতে হয়। রায়মঙ্গল কাব্যের অন্যতম কবি হরিদেব তার কাব্যে লিখেছেন, গণেশের সেই মস্তকটি নিম্নবঙ্গে পতিত হয়ে ক্ষেত্রপাল রূপে দক্ষিণের ঈশ্বরে পরিণত হয়েছেন। তার নাম হল দক্ষিণরায়। তিনি ধীবরদের দ্বারা পূজিত হন। তিনি বাঘ দেবতা। কেউ কেউ দক্ষিণ রায়কে শিবরে আরেক রূপও বলে থাকেন।
আশ্চম্বিতে উচাটিল গণেশের মাথা।
দক্ষিণে আসিয়া সেই হইল দেবতা।।
দক্ষিণবঙ্গে মাতা নারায়ণীর সঙ্গেই দক্ষিণরায় পূজিত হন। দক্ষিণবঙ্গে দক্ষিণ রায়ের পুজো হয় গণেশের ধ্যানমন্ত্রে। গণেশের আদি মুন্ডের উপাসনা যেমন এককালে অতিজনপ্রিয় ছিল, তেমন একইভাবে হাতি-মস্তক গণেশের পুজোও প্রাচীনকালে বহুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সুন্দরবন থেকে অসংখ্য গণেশের প্রস্তর ও টেরাকোটা মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। যার ভাস্কর্যশৈলী প্রমাণ করেন খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতক থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে নির্মাণ করে হয়েছিল। আর আমাদের মধ্যে পয়লা বৈশাখ, অক্ষয় তৃতীয়ায় গণেশ পুজোর রীতি তো ছিলই। আবার দুর্গার সঙ্গেও তার সন্তান রূপে গণেশ পূজিত হন। সেই সঙ্গে বিস্তীর্ন প্রান্তিক বাংলা আদি মুণ্ড আর হস্তী মুণ্ড দুইরকম গণেশের উপাসক। অর্থাৎ গণেশ কেবল পশ্চিমের নয়, পূর্বেরও। আদপে গোটা ভারতেরই।