কালীকথা: ব্রহ্মময়ী কালী; বামাক্ষ্যাপা, রামপ্রসাদ, রানি রাসমণি রামকৃষ্ণকে একসূত্রে বেঁধে যে মন্দির

কালী নিয়ে বেদ বলছে, 'কালী করালি মনজবা চ ধুম্রাক্ষী স্ফুলিঙ্গিনী লোলজিহ্বা।' অর্থাৎ সে সময় যজ্ঞের শিখাকে কালী নামে ডাকা হত। শিখাকে দেবী আর ছাই হল ভষ্ম মাখা শিব। নিরাকার ব্যাপারটা কেমন সাকারের সঙ্গে আস্তে আস্তে মিশছে। শাক্ত মতে, কালী বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদি কারণ, তিনিই দশমহাবিদ্যার প্রধান তান্ত্রিক দেবী। তন্ত্রগ্রন্থ ব্রহ্মযামল বলে, কালী বঙ্গদেশের অধিষ্ঠাত্রী দেবী।

দক্ষিণা কালিকা, সিদ্ধেশ্বরী কালিকা, গুহ্য কালিকা, শ্রী কালিকা, শ্মশান কালিকা ও মহাকালী ছাড়াও রয়েছে, ক্ষেমঙ্করী ও ভয়ঙ্করী। বাড়িতে বাড়িতে ক্ষেমঙ্করীর পুজো হয়। ভয়ঙ্করীর পুজো চলে শ্মশানে। মোটামুটি সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলায় কালীপুজোর প্রচলন বলে ধরা যেতে পারে। আর কলকাতাকে তো বহু যুগ আগে থেকেই ঐতিহাসিকরা কালীক্ষেত্র বলে বসেছেন। তবে আজ আমাদের কালীকথায় কলকাতার অদূরের এক মন্দিরের কথা উঠে আসবে। শ্যামনগর, গঙ্গা তীরের এক জনপদ। সেখানে রয়েছে মা ব্রহ্মময়ী কালী। এই কালী মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রবি ঠাকুরের পরিবারও। বাংলার ১২১৯ সালের ৩১ শে বৈশাখ ​মূলাজোড় ব্রহ্মময়ী কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হিন্দু কলেজের গভর্নর তথা দ্বারকানাথ ঠাকুরের জ্যাঠামশাই পাথুরিয়াঘাটার জমিদার শ্রী গোপীমোহন ঠাকুর। ইংরেজি সাল ধরলে ১৮১২/১৩ সাল হবে।

গোপীমোহনের ৬ পুত্র ছিল। তারা হলেন সূর্যকুমার ঠাকুর, চন্দ্রকুমার ঠাকুর, নন্দকুমার ঠাকুর, কালীকুমার ঠাকুর, হরকুমার ঠাকুর এবং প্রসন্নকুমার ঠাকুর। এছাড়াও ছিল একটি কন্যা। গোপীমোহনের একমাত্র কন্যার নাম ছিল ব্রহ্মময়ী। সে সময় কৌলীন্য প্রথার জন্য কুমারী মেয়েদের অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেওয়ার রীতি প্রচলিত ছিল। আট বছর বয়সে এই বিয়ে দিয়ে দেওয়ার রীতিটি গৌরিদান নামে পরিচিত ছিল। ঠাকুর পরিবারও এর ব্যতিক্রম ছিল না। তখনও ব্রহ্ম ধর্ম জাঁকিয়ে বসেনি। প্রথা মেনে আট বছর বয়সেই ব্রহ্মময়ীরও বিয়ে ঠিক হয়। বিয়ের দিন সকালে পালকি করে ব্রহ্মময়ীকে গঙ্গা স্নানে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু গঙ্গায় ডুব দেওয়া মাত্রই ব্রহ্মময়ীকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে, কন্যা শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েন গোপীমোহন। এর ঠিক দিন তিনেক পর গোপীমোহন স্বপ্নাদেশ পান। স্বপ্নাদেশে ব্রহ্মময়ী গোপীমোহনকে বলে, সে মূলাজোড়ে আছে, তাকে পাথরের মূর্তিতে পাওয়া যাবে। স্বপ্নাদেশ পেয়ে গোপীমোহন ছুটে আসেন মূলাজোড়ে। মূলাজোড় তখন জঙ্গলে ঘেরা। গোপীমোহন মূলাজোড়ে পৌঁছে এক পাষাণময়ী দেবীমূর্তিকে দেখেন, যা মাটির মধ্যে পড়ে রয়েছে। কষ্টিপাথরের কালীমূর্তি, মাতৃ মূর্তির পদতলে শায়িত রয়েছেন মহাদেব।

গোপীমোহন সেই মূর্তি দেখে অভিভূত হন। পরবর্তীতে তিনি খ্যাতনামা গায়ক কালিদাস চট্টোপাধ্যায়ের সাথে মিলে সেই স্বপ্নদেশের ঘটনাকে উপজীব্য করে একটি শ্যামাসংগীত রচনা করেন। মন্দির গাত্রে সেই পদ খোদাই করান। পদটি ছিল, 'শিবে শবাসনা, লোল রসনা/ভীষণা দিগবসনা বিকট দশনা।/লজ্জারূপা নাহি লজ্জা মেয়ে হয়ে রণসজ্জা, রুধিরে মগনা।/সভয়া অভয়া বরে সতী নিজ পতি পরে,/এ কি বিবেচনা/কহিছে গোপীমোহনে এইরূপ জাগে মনে, কালী ত্রিনয়না।।

গোপীমোহন আশেপাশের মানুষদের থেকে জানতে পারেন এই বিগ্রহটি প্রথমে দক্ষিণ দিকে ছিল। কোনও একসময় রামপ্রসাদ গঙ্গাবক্ষ দিয়ে হালিশহরে ফিরছিলেন। সে'সময় রামপ্রসাদের মধুর গানে আকর্ষণ বোধ করেন দেবী। তারপরে মূর্তিটি পশ্চিমদিকে ঘুরে যায়। এই ঘটনা নিয়ে জনশ্রুতি রয়েছে, মা নাকি রামপ্রসাদকে বলেছিলেন আমায় গান শুনিয়ে যা। রামপ্রসাদ উত্তরে বলেছিলেন, পারব না তুই ঘুরে শোন। এরপরেই নাকি মূর্তিটি পশ্চিমমুখী হয়ে যায়। গোপীমোহন মন্দির স্থাপন করেন। মূর্তিটির কোনরূপ পরিবর্তন তিনি করেননি। মন্দিরের সোপানের কাছে দুটি স্তম্ভের উপর শ্বেত পাথরের দুটি সিংহ মূর্তি স্থাপন করা হয়। উপরের আরও দুটি স্তম্ভের উপর বিষ্ণুমূর্তি স্থাপন করা হয়। ১৮০৯ মতান্তরে ১৮১২ সালে মন্দির স্থাপন করে গোপীমোহন ঠাকুর মন্দিরের নাম রাখেন মূলাজোড় ব্রহ্মময়ী কালীমন্দির। আরামবাগ থেকে পণ্ডিত এনে মন্দিরের বিগ্রহ পুজোর বন্দোবস্ত করেন গোপীমোহন ঠাকুর। মূলাজোড়ের প্রথম পণ্ডিত ছিলেন চন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। মন্দিরের বাম ও ডান দিকে ছয়টি করে শিব মন্দির স্থাপনের কাজ শুরু করেন গোপীমোহন। কিন্তু কাজ শেষ করার আগেই হঠাৎ করে গোপীমোহনের মৃত্যু ঘটে। সময়টা বাংলার ১২২৫ সন, ইংরেজি ১৮১৮ সাল।

গোপীমোহনের মৃত্যুর পর মূলোজোড়ের দায়িত্ব এসে পড়ে পুত্র হরকুমার এবং প্রসন্নকুমারের উপর। হরকুমার মূলাজোড়ে দ্বাদশ শিবলিঙ্গ স্থাপন করেন। বাইরের দিকে আরও তিনটি অতিরিক্ত শিবলিঙ্গ স্থাপন করেন। সে সময় মূলাজোড় সংলগ্ন বিধবা মহিলাদের ভরণপোষণের জন্য এগুলি স্থাপন করা হয়েছিল। দ্বাদশ শিবলিঙ্গগুলির নাম দিয়েছিলেন হরকুমার। সেগুলো হল, ১) মহাকালেশ্বর,  ২)কেদারনাথ, ৩)সোমনাথ, ৪)ওমকারেশ্বর, ৫)মল্লিকার্জুন,৬)ভীমশঙ্কর, ৭)কাশী বিশ্বনাথ, ৮)ত্রিম্বকেশ্বর, ৯)বৈদ্যনাথ, ১০)নাগেশ্বর, ১১)রামেশ্বরম, ১২)গ্রীষ্ণেশ্বর। এই মূলাজোড় গ্রামে বসেই রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র 'অন্নদামঙ্গল রচনা' করেছিলেন। ডালহৌসির আমলে রেলপথ স্থাপনের সময় মূলাজোড় গ্রামটির পরিবর্তে শ্যামনগর নামকরণ করা হয়। রাণী রাসমণী এখানে প্রায় আসতেন, তিনি এই মন্দির দেখে এতটাই অভিভূত হন যে পরবর্তীকালে মূলাজোড় নবরত্ন মন্দিরটির আদলে দক্ষিণেশ্বরের বিখ্যাত কালীমন্দিরটি স্থাপন করেছিলেন।

প্রসন্নকুমারের আমলে মূলাজোড় কালীমন্দিরের আমূল পরিবর্তন হয়। কালীমন্দিরের সামনে বিরাটাকার নাটমন্দির তৈরি করা হয়। শিব মন্দির গুলির মধ্যে দশটি আটচালা এবং দুটি পঞ্চরত্ন আকারে গড়ে তোলা হয়। বাহিরের তিনটি শিবমন্দিরের নাম আনন্দশংকর, গোপীশংকর এবং হরশংকর। প্রায় ১০০ বছর আগে পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর বাড়িতে যে 'গোপীনাথ জিউ' ছিলেন তাঁকে মন্দিরের পাশে এনে প্রতিষ্ঠা করা হয়। মূলাজোড় মন্দির এবং শিব মন্দির গুলি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রসন্নকুমার প্রতি মাসে ১ হাজার টাকা বরাদ্দ করেন। প্রসন্নকুমার মূলাজোড়ে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় এবং অবৈতনিক সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।১৮৬৮ সালের ৫ ই জুলাই প্রসন্নকুমার একটি উইল তৈরি করেন যেখানে মূলাজোড়ে সংস্কৃত কলেজ নির্মাণের জন্য ৩৫ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়। সংস্কৃত কলেজে বহু জ্ঞানীগুণী মানুষ শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন। বিশ্বকোষ প্রণেতা রঙ্গলাল মুখোপাধ্যায়, রঙ্গলালের ভ্রাতা সাহিত্যিক ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় মূলাজোড়ের সংস্কৃত কলেজ এবং টোল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। মূলাজোড়ের সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ শিবচন্দ্র সার্বভৌম মহাশয় মহামোহপাধ্যায় উপাধি পেয়েছিলেন।তিনি মূলাজোড়ের সংস্কৃত কলেজে বসেই রচনা করেছিলেন 'কুসুমাঞ্জলি' 'পাণ্ডব চরিত'।মূলাজোড়ের অপর বিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন রামনাথ তর্কপঞ্চানন। বিধবা বিবাহ সংক্রান্ত পরামর্শের জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয় রামনাথ বাবুর কাছে প্রায়ই আসতেন। কথিত আছে, শ্রীরামকৃষ্ণের দাদা রামকুমার চট্টোপাধ্যায় মূলাজোড় সংস্কৃত কলেজ থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করেছিলেন।

শোনা যায়, যতীন্দ্রমোহনের আমলে সাধক বামাক্ষ্যাপা মূলাজোড়ে এসে সাধনা করেছিলেন। তখন মূলাজোড়ের প্রধান পুরোহিত ছিলেন চন্দ্রনাথের পুত্র রামনাথ মুখোপাধ্যায়। রামনাথ বামাক্ষ্যামার সংস্পর্শে এসে দিব্যজ্ঞান জ্ঞান লাভ করেন। বামাক্ষ্যাপা অসহায় দীন মানুষদের সেবা করার জন্য যতীন্দ্রমোহনকে আদেশ দেন। সেইসময় থেকে মূলাজোড়ে এলাহি ভোগের ব্যবস্থার সূচনা ঘটে, যেখানে সমগ্র মূলাজোড়ের অন্নহীন মানুষদের অন্নসংস্থান শুরু হয়। অবশ্য অধুনা এই ভোগ প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে। এখন ৩১ শে বৈশাখ এবং দীপান্বিতা কালীপুজোর দিন অন্নহীনদের অন্ন দেওয়া হয়। দেবীকে পৌষ মাসে জোড়ামূলা দিয়ে বিশেষ পুজোর রীতি চলে আসছে। সারা বছর ধরে, ভক্তরা এই মন্দিরে পুজো দিতে আসেন। স্থানীয়দের বিশ্বাস, মা ব্রহ্মময়ী অত্যন্ত জাগ্রত দেবী। 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...