গঙ্গার মতোই পবিত্র নদী গণ্ডকী। নেপালের মুস্তং জেলার জমসমে এই নদীর উৎপত্তিস্থল। সেখান থেকে উত্তর প্রদেশের বুক চিরে পাটনায় এসে সে মিলিত হয়েছে পতিতপাবনী গঙ্গার সঙ্গে। নেপালে এই নদীকে বলা হয়, ‘কালীগণ্ডকী’। তার জল কাজলের মতো স্বচ্ছ। তার বুকে পাওয়া যায় শালগ্রাম শিলা। হ্যাঁ, শুধু তারই বুকে পাওয়া যায়। ভগবান বিষ্ণুর প্রতীকী মূর্তিরূপে পূজিত হয় শালগ্রাম। এই শিলা বিশেষ, কেননা তার অঙ্গে অপূর্ব কারুকাজ থাকে। বিজ্ঞান বলে, এই কারুকাজ আসলে বহু প্রাচীন কোন কীটের শিলাভূতরূপ। ফসিল। পুরাণের যুগে বিজ্ঞানের এই ব্যাখ্যা দেবার মতো কেউ ছিলেন না। তাই সে-কালের মানুষ গণ্ডকী নদীর বুকে কেন শালগ্রামের মতো অদ্ভুতদর্শন শিলা পাওয়া যায়; সেই সম্পর্কে নিজেদের মতো করে কাহিনি তৈরি করে নিয়েছিলেন। সেই কাহিনি আজ কিংবদন্তি।
কিংবদন্তি অনুযায়ী, বহু প্রাচীনকালে গণ্ডকী নামের এক বারবণিতা বাস করত। সে উপার্জনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পুরুষ-সংসর্গ করলেও অত্যন্ত ধার্মিক ছিল। নীতিপরায়ণা ছিল। নিষ্ঠাবতী ছিল। একদিনে সে একজন পুরুষের সঙ্গেই সে মিলিত হত। সেই দিনটির জন্য সে ওই পুরুষটিকেই স্বামীর আসনে বসাত। স্বামীর প্রতি স্ত্রীর যে কর্তব্য, তাই-ই পালন করত। বিশ্বাস বজায় রাখত। সেবা করত। অর্থের বিনিময়ে হলেও পুরুষটি যেহেতু একটি রাতের জন্য তার অতিথি, তাই সে শাস্ত্রবাক্য মেনে অতিথিকে নারায়ণজ্ঞানে পুজো করত। টাকাপয়সার লোভ দেখিয়ে, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে অনেক চেষ্টা করেও তার এই নৈতিকতার জায়গা থেকে কেউ তাকে টলাতে পারেনি।
ভগবান বিষ্ণু তো সবই জানেন, সবই দেখেন; তিনি নিজে এবার গণ্ডকীর এই নৈতিকতার জায়গাটি কতটা দৃঢ়, সেটা পরীক্ষা করতে মনস্থ করলেন। দিনমানে এক সুন্দর যুবকের রূপ ধরে তিনি এলেন গণ্ডকীর দ্বারে। গণ্ডকীকে বললেন যে, আজ রাতে তিনি তার অতিথি হতে চান। সেই কথায় গণ্ডকী সম্মতি জানিয়ে বলল যে, সন্ধের সময় সে তাঁর জন্য অপেক্ষা করবে। তার সম্মতি পেয়ে যুবক চলে গেল।
তারপর ক্রমে দিন গেল। সন্ধে পেরোল। রাত্রি হল। তবুও যুবক এল না। কিন্তু গণ্ডকী সেই যুবকের পথ চেয়ে ঠায় বসে রইল। তাকে একা বসে থাকতে দেখে মধ্যিখানে কত সুপুরুষ এল, যুবকের চেয়েও অনেক অনেক বেশি অর্থ দেবার অঙ্গীকার করল, কত অনুনয় করল; তবুও গণ্ডকী তার নীতি থেকে সরে এল না। জানাল যে, একজনকে সে কথা দিয়েছে; সে না-এলেও এই রাত তার, এলেও তার!
সারাটি রাত ঠায় গণ্ডকী বসে রইল যুবকের প্রতীক্ষায়। যেমনভাবে বসেছিল সন্ধেবেলায়, তেমনভাবেই। অবশেষে একে একে অপেক্ষার মুহূর্তগুলি পেরিয়ে সেই যুবক এল রাত্রির শেষপ্রহরে। যুবককে নিয়ে ঘরে আসার পর গণ্ডকী দেখল যে, তার সারা গায়ে গলিত কুষ্ঠ। সেই কুষ্ঠক্ষতের অসহ্য জ্বালায় অচিরেই যুবকটি অত্যন্ত কাতর হয়ে উঠল। স্ত্রী যেমন স্বামীর অসুস্থতায় ঘৃণা দেখায় না, নিষ্ঠা ভরে সেবা করে; তেমনিভাবেই গণ্ডকী যুবকের সেবায় নিযুক্ত হল। কিন্তু তাতে তেমন কোন লাভ হল না। রাত শেষ হবার আগেই যুবকটি মারা গেল।
সকালে গণ্ডকী যুবকের শেষযাত্রার আয়োজন করল, তাকে দাহ করার ব্যবস্থা করল। সেকালে স্বামীর সঙ্গে একই চিতায় সহমরণের নির্মম ও অমানবিক প্রথা সমাজে প্রচলিত ছিল। যে রাতের জন্য গণ্ডকী যুবককে স্বামী হিসেবে স্বীকার করেছিল, সেই রাত শেষ হবার আগেই যুবকের মৃত্যু হয়েছে। তাই মৃত্যুর পরও যুবকটি গণ্ডকীর স্বামী। গণ্ডকী সিদ্ধান্ত নিল স্বামীর সঙ্গে সে সহমরণে যাবে। তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিরস্ত করার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। যুবকের মাথা কোলে নিয়ে গণ্ডকী চোখ বন্ধ করে বসে পড়ল চিতায়। বেজে উঠল ঢাক, ভেরি, দামামা। শ্মশানযাত্রীরা চিতায় আগুন দিতে উদ্যত হল। কিন্তু তখনই যুবক রূপান্তরিত হয়ে গেলেন স্বয়ং নারায়ণে। তাই দেখে সকলে চমকে উঠল। বাদকদের বাদ্য থেমে গেল। যারা আগুন দিতে উদ্যত হয়েছিল, তারাও স্থির হয়ে গেল।
গণ্ডকী চোখ বন্ধ করে বসেছিল চিতায়। সবকিছু থেমে যেতে সে অবাক হল। তখনই শুনল সেই যুবকের কণ্ঠে তার নাম। অমনি সে সচকিত হয়ে চোখ খুলল। দেখল, তার কোলে স্বয়ং নারায়ণ শুয়ে! বিহ্বল হয়ে গেল সে তাই দেখে। তাকে বিহ্বল হতে দেখে লীলাময় নারায়ণ মুখের স্মিত হাসি নিয়ে উঠে বসলেন। বললেন, বিহ্বল হয়ো না গণ্ডকী, তুমি ঠিকই দেখছ, আমি তোমার পরম আরাধ্য নারায়ণ। অতিথিকে তুমি আমায় ভেবেই তো পুজো করতে। তাই অতিথির বেশেই আমি তোমার কাছে এসেছিলাম তোমার আদর্শের দৃঢ়তা পরীক্ষা করতে। তাতে বুঝেছি, তুমি অনন্যা। তোমার প্রতি আমি এতটাই প্রসন্ন যে, তোমাকে একখানা বর দিতে চাই। এখন বল, কী বর চাও!
নারায়ণের এমন অযাচিত কৃপা পেয়ে গণ্ডকী ধন্য হল। তার মতো আদর্শবতী ভক্তিমতী নারী যা চাইতে পারে, তাই-ই সে চেয়ে বসল নারায়ণের কাছে। শতকোটি প্রণাম জানিয়ে হাতজোড় করে বলল, প্রভু, চিতায় আমার কোলে তোমাকে যেভাবে ধারণ করেছিলাম, সেভাবেই যেন তোমায় ধারণ করে থাকতে পারি—শুধু এটুকুই আমার চাওয়া, আর কিছুই চাই না।
নারায়ণ গণ্ডকীর এই নিষ্কাম প্রার্থনায় অত্যন্ত প্রসন্ন হলেন। বললেন, তথাস্তু। তাই হবে। তুমি অতি পবিত্র নদী গণ্ডকী হয়ে প্রবাহিত হবে, আর আমি তোমার কোলে শালগ্রাম শিলারূপে সারাজীবন অবস্থান করব। তোমার পুণ্যধারায় স্নান করে মানুষ যেমন জীবনের সমস্ত পাপ ধুয় ফেলতে পারবে, তেমনি আমায় শালগ্রামরূপে পুজো করে মানুষ লাভ করবে মোক্ষের ফল।
নারায়ণের কথা শেষ হতেই গণ্ডকী নদী হয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করল, আর নারায়ণ অনন্ত শালগ্রামরূপে আশ্রয় নিলেন গণ্ডকীর কোলে। তাই সেই প্রাচীনকাল থেকে আজও গণ্ডকীর বুকে শালগ্রামশিলা পাওয়া যায়।
পরবর্তীকালে নারায়ণ ও গণ্ডকীর এই কৃপার কথা স্মরণ করে গণ্ডকীর উৎসস্থলে গড়ে উঠল ভগবান বিষ্ণুর মন্দির। বিষ্ণু যেমন বারবণিতা গণ্ডকীকে মুক্তি দিয়েছিলেন, শালগ্রামরূপে পূজিত হয়ে সকলকে মুক্তি দেন; তাই তিনি এখানে ‘মুক্তিনাথ’ নামে অধিষ্ঠিত।
তবে মুক্তিনাথ মন্দিরপ্রাঙ্গণে মুক্তিনাথ একা নেই। তাঁর নিকটেই রয়েছে একটি বিখ্যাত সতীপীঠ। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, দেবী সতীর ডানদিকের গাল বিষ্ণুর সুদর্শনে কর্তিত হয়ে এই পুণ্যভূমিতে পতিত হয়েছিল। ‘গাল’কে সংস্কৃতে বলা হয় ‘গণ্ড’। এছাড়াও দেবী যেহেতু গণ্ডকী নদীর তীরে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, তাই দেবীকে ‘গণ্ডকীচণ্ডী’ নামে অভিহিত করা হয়। দেবীর ভৈরব এখানে ‘চক্রপাণি’। ‘চক্রপাণি’ বলা হয় বিষ্ণুকে। কেননা, তাঁর ‘পাণি’ বা হাতে সুদর্শনচক্র শোভা পায়। পুরীর জগন্নাথধামে অধিষ্ঠিতা দেবী বিমলার ভৈরব যেমন জগন্নাথ-বিষ্ণু, তেমনি এখানেও দেবীর ভৈরব মুক্তিনাথ-বিষ্ণু। আসলে, পুরাণেই বলা আছে যে, হরি ও হর একই আত্মার দুই রূপ। যিনিই শিব, তিনিই বিষ্ণু। উল্লেখ্য যে, মন্দিরপ্রাঙ্গণে ‘চণ্ড’ নামের শিবের মন্দির আছে, তবে তিনি দেবীর ভৈরব নন।
মুক্তিনাথের মন্দির ও মুক্তিনাথের মাহাত্ম্য এতটাই বিস্তৃত যে, তার আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে দেবী গণ্ডকীচণ্ডীর কথা। দেবী এখানে যেন কিছুটা উপেক্ষিতও। রয়েছে দর্শনার্থীদের সচেতনতারও অভাব। যারা সচেতন ভক্ত, যেমন সাধু-সন্ন্যাসী; তাঁরা জানেন দেবীর মাহাত্ম্য, কিন্তু অদ্ভুতভাবে তাঁদের বিবরণেও দেবীর কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না। শুধু শোনা যায় যে, দেবী এখানে শিলারূপে পূজিতা হন। দেবীর ‘গণ্ড’ এখানে পতিত হওয়ার পরই তা শিলায় রূপান্তরিত হয় এবং তাই-ই পূজিত হচ্ছে। চৈত্র মাসে নবরাত্রি অনুষ্ঠান এখানে খুব ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয়, ন’দিন ধরে দেবীর বিশেষ পূজা করা হয়। আশ্বিন মাসে দেবীপক্ষে দেবীর বিশেষ পূজার্চনা ও যজ্ঞ হয়ে থাকে। এছাড়া শিবরাত্রিও এখানে বিশেষভাবে পালিত হয়।
মন্দিরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তিন হাজার আটশ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। অত্যন্ত প্রাচীন এই মন্দির বুদ্ধমন্দির বা প্যাগোডার আকারে নির্মিত। খোলা আকাশের নীচে রয়েছে বুদ্ধদেবের মূর্তিও। আসলে মুক্তিনাথ যেমন হিন্দু বৈষ্ণবদের তীর্থ, তেমনই শৈবদের তীর্থ, শাক্তদের তীর্থ, বৌদ্ধদের তীর্থ, সর্বধর্মসমন্বয়বাদীদের তীর্থ। প্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতির ওপর একদা বৌদ্ধদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়, তারপর আবার তা হিন্দুদের হাতে আসে; সংস্কৃতির এই বিবর্তনের চিহ্ন এই হিমালয়ক্ষেত্রের আশেপাশেই বেশি চোখে পড়ে। চোখে পড়ে সেই ইতিহাস মাথায় নিয়ে সম্ভব-সুন্দর সহাবস্থানের চিত্র। তাই এই মন্দিরে হিন্দু ও বৌদ্ধ পুরোহিত নিজের নিজের মতে একসঙ্গে পুজো করেন।
মন্দির প্রাঙ্গণে ‘পাপকুণ্ড’ ও ‘পুণ্যকুণ্ড’ দুটি পুষ্করিণী আছে; একটিতে পাপ ধুয়ে অন্যটিতে স্নান করে ভক্তেরা পুণ্য অর্জন করেন। এছাড়া আছে একশ আটটি ধারা। পাহাড়ের গা থেকে নেমে আসা ঝর্ণার ধারা একের পর এক ধাতব ষাঁড়ের মুখ বেয়ে পতিত হচ্ছে, সেই একশ আট ধারায় স্নান করেও পুণ্য অর্জন করতে চান ভক্তেরা। তাছাড়া মুক্তিনাথ তো স্বয়ং মোক্ষদায়ী। মা গণ্ডকীচণ্ডীও তাই। তিনিও এখানে ভক্তদের কলুষ দূর করে কৃপা করে দেন মুক্তিপথের সন্ধান, দেন অক্ষয় আনন্দের আশীর্বাদ।।...