শো-ম্যান রাজ কাপুরের কণ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
একসময় কে এল সায়গালের গান খুবই গাইতেন, পরে অবশ্য স্বতন্ত্র নিজস্ব এক গায়কি তৈরি করেন।
এখনও চিনতে পারছেন না?
কহি দূর যব দিন ঢল যায়ে', 'কভি কভি মেরে দিলমে' বা 'ম্যায় পল দো পলকা শায়ের হু'— এই গানগুলোর কথা ভাবলে নিশ্চয়ই পারবেন! 'মেরা জুতা হ্যায় জাপানি' বা 'এক পেয়ার কা নাগমা হ্যায়'? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। মুকেশ।গানের জগতে সে-সময় রফি-কিশোর-মান্নার সঙ্গে টক্কর দিতে হত তাঁকে। আসলে তিনি এমন সময়ে গাইতেন যাকে ভারতীয় চলচ্চিত্র সঙ্গীতের স্বর্ণযুগ বলা চলে। পাল্লা দিয়ে ভালো লড়েছেন তিনি, তাইতো আজও তাঁর গানের জনপ্রিয়তায় এক ফোঁটা ভাটা পড়েনি। প্রায় কম বেশি ১২০০ গান শ্রোতারা উপহার পেয়েছে তাঁর কণ্ঠ থেকে। একটু খামখেয়ালি গোছের মানুষ ছিলেন, মর্জিমাফিক চলতেন নয়তো আরও কয়েক হাজার গান বেড়ে যেত তালিকায়।তাঁর গানের শুরুটাও হয়েছিল হঠাৎ করেই, দুর্ঘটনাবশতই বলা চলে। ১৯২৩ সালের ২২ জুলাই মুকেশের জন্ম হয় লুধিয়ানায়। পুরো নাম ছিল মুকেশ চন্দ মাথুর। ছোটোবেলায় তাঁদের বাড়িতে, মুকেশের দিদিকে গান শেখাতে আসতেন এক গানের শিক্ষক। ছোট্ট মুকেশের গান শুনে, এ ছেলে যে একদিন মস্ত বড়ো গায়ক হবে বুঝেছিলেন সেই গানের শিক্ষক। এরপর বাড়িতেই গান শেখা চলতে থাকে মুকেশের। দিল্লির দরবারি ঘরানা থেকে শাস্ত্রীয় গান, সব কিছুই শিখলেন তিনি।
শেখা তো হল, এবার তাঁর প্রথম গান গাওয়ার পালা। সেটাও হলো, সুযোগ এসে গেল ওই হঠাৎ করেই একদা এক বিয়েবাড়ি গিয়েছেন মুকেশ, সঙ্গে বাবা মা। তাঁদের এক আত্মীয়ের বিয়ে ছিল, সেই বিয়ের আসরেই গান গাইছিলেন মুকেশ। ওই বিয়ের আসরে উপস্থিত ছিলেন মোতিলাল, তদানীন্তন সময়ে হিন্দি ছবির জনপ্রিয় একজন অভিনেতা।
মোতিলাল মুকেশের গান শুনে এতটাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন যে, তিনি মুকেশকে মুম্বই নিয়ে আসেন এবং পণ্ডিত জগন্নাথ প্রসাদের কাছে গান শেখার ব্যবস্থা করেন। ওই সময়ে 'নির্দোষ' নামের একটি ছবিতে নায়ক ও গায়ক হিসেবে সুযোগ পান মুকেশ। 'নির্দোষ' ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৪১ সালে, এই ছবিতেই প্রথম মুকেশের কণ্ঠ সর্বসমক্ষে আসে। শ্রোতারা প্রথম বার শোনেন মুকেশকে।
এরপর ১৯৪৫ সাল, 'পেহলি নজর' সিনেমায় প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে নিজের যাত্রা শুরু করলেন মুকেশ। মুকেশ হিন্দি ছবিতে গাইছেন, শ্রোতাদের মন জয় করছেন। কিন্তু তাও যেন কিছু একটার অভাব। ওই সময়ে হিন্দি চলচ্চিত্র ও গানের জগতে বাঙালিদের রাজত্ব চলত। সঙ্গীত পরিচালক থেকে গীতিকার, সুরকার; সংখ্যাগরিষ্ঠই ছিলেন বাংলা থেকে, অবাঙালি গায়করাও মুখিয়ে থাকতেন বাংলা গান করার জন্যে। বহু কষ্ট করে ভাষা বুঝে, ভাব বুঝে, সঠিক উচ্চারণ শিখে তবে তাঁরা গাইতেন। কারণ বোম্বেতে সে সময় প্রচলিত ছিল যে শিল্পী বাংলার ভালোবাসা পাননি, তিনি জনপ্রিয়তায় খানিক হলেও পিছিয়ে আছেন। তাই অবাঙালি গায়কদের একটি লক্ষ্যই থাকত, তাঁরা বাংলা গান গাইবেন। স্বপ্নও বলা যায়।মুকেশও তাঁর ব্যতিক্রম ছিলেন না।
তৎকালীন সময় একেকজন দিকপাল সুর ও সঙ্গীত স্রষ্টা, সেই সঙ্গে গানের বিদগ্ধ শ্রোতা, এই দুইই কেবল বাংলায় মিলত। তাই মুকেশও চেয়েছিলেন তাঁর কণ্ঠ পৌঁছে যাক বাংলার ঘরে ঘরে। মুকেশে খুব ভাল বন্ধু ছিলেন গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কাছে মুকেশ বলেছিলেন, তিনি বাংলা গান গাইতে চান।
মুকেশকে দিয়ে বাংলা গান গাওয়ানোর প্রস্তাব নিয়ে গ্রামাফোন কোম্পানির কাছে গিয়েছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সে-যাত্রায় মুকেশকে দিয়ে বাংলা গান গাওয়াতে রাজি হননি গ্রামাফোন কোম্পানির কর্মকর্তারা। পুলকবাবুর পাল্টা যুক্তি ছিল, মুকেশ বাংলা গান গাইছে শুনলেই শ্রোতাদের মধ্যে রীতি মতো হইচই পড়ে যাবে। কিন্তু গ্রামাফোন কোম্পানির কোন এক কর্তা তাঁর দাবি নস্যাৎ করে দিয়ে বলেছিলেন, 'সরি'। পুলকবাবু হেরে যাননি, এই 'সরি' দিয়েই গান গাওয়ালেন মুকেশকে।
দিলীপ বসু সে-সময় সন্ধ্যা রায় ও বিশ্বজিৎকে নিয়ে তৈরি করছিলেন একটি ছবি 'সরি ম্যাডাম'। গান লেখার ভার ছিল পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর, ছবির সঙ্গীত পরিচালক ভেদ পাল। পুলকবাবু ওই গ্রামাফোন কোম্পানীর সরি শব্দ দিয়েই গান লিখলেন, সরি ম্যাডাম সরি। গাওয়ালেন মুকেশকে দিয়েই। ভেদ পাল ও মুকেশ বন্ধু ছিলেন, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় বলতেই ভেদ পাল রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। বাংলা প্লেব্যাক করে ফেললেন মুকেশ। বেসিক বাংলা গানের আগেই বাংলা ছবির জন্যে গাওয়া হয়ে গেল তাঁর, ছবি মুক্তি পেল ১৯৬২ সালে।
এরপরে গ্রামাফোন কোম্পানির ‘না কেও ‘হ্যাঁ’-তে পরিবর্তিত করিয়েছিলেন মুকেশ। না, ঠিক মুকেশ নন। তাঁর জনপ্রিয়তা। মুকেশের জনপ্রিয়তা দেখে ১৯৬৬ সালে দুটি বাংলা গান তাঁকে দিয়ে গাওয়ায় গ্রামাফোন কোম্পানি। রতু মুখার্জীর সুরে এবং পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় সেই দুটি গান রেকর্ড নিয়েও কম ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়নি। কলকাতায় গানের জলসা করতে আসছেন মুকেশ, সেই দিনই রেকর্ডের ডেট ফেলা হল। কিন্তু সারাদিন চেষ্টা করেও গান দুটি নির্ভুল উচ্চারণে গাইতে পারলেন না মুকেশ। অগত্যা বোম্বের স্টুডিওর ডেট নেওয়া হল, রতু মুখোপাধ্যায় ও পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ধরলেন মান্না দে-কে। মান্না দে মুকেশকে গান তুলিয়ে পাঠালেন। গান রেকর্ড হল মুম্বইয়ের স্টুডিয়োতেই, গান দুটি হল 'ওগো আবার নতুন করে ভুলে যাওয়া নাম ধরে ডেকো না' এবং 'দেহেরই পিঞ্জিরায় প্রাণ পাখি'। এই প্রথম বেসিক বাংলা গান গাইলেন মুকেশ।
১৯৬৬-তে পীযুষ বসু তৈরি করলেন একটি জীবনী-নির্ভর ছবি, নাম 'সুভাষ চন্দ্র'। বোঝাই যাচ্ছে দেশনায়কের জীবনী। সেখানেই অপরেশ লাহিড়ীর সঙ্গীত পরিচালনায় মুকেশ গাইলেন 'জয় রাধে শ্যাম রাধাকুণ্ড শ্যামকুণ্ড গিরি গোবর্ধন।'
আবার বাংলা ছবির গান পেল মুকেশের কণ্ঠ।
তারপর সময়টা ১৯৬৮ হবে, সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরে মুকেশ গাইলেন 'মন মাতাল সাঁঝ সকাল, কেন শুধুই ডাকে'। সলিল চৌধুরীর খুবই প্রিয়পাত্র ছিলেন মুকেশ। এরপরে সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরে আরেকটি বাংলা গানে আমরা শুনেছি মুকেশের কণ্ঠ, অন্যতম জনপ্রিয় সে গান— 'ঝুন ঝুন ময়না নাচো না, তাথৈ তাথৈ নাচো না'।
মিল্টু ঘোষের কথা ও ভি বালসারার সুরে, মুকেশের কণ্ঠে দুটি বাংলা গান সৃষ্টি হল, যা ১৯৭২ নাগাদ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। আজও গান দুটি বাংলা গানের শ্রোতাদের খুবই পছন্দের। 'মন্দ বলে লোকে বলুক না' এবং 'ও ময়না রে'।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুর ও মুকুল দত্তের কথায় মুকেশ গাইলেন 'আমার মনের কত সুখ নিয়ে সারা বেলা' এবং 'মনকে কিছু বলো না'।
এভাবেই ভাষা, উচ্চারণ ও ভাবাবেগের সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে, গায়কেরা হয়ে ওঠেন আপামর সঙ্গীত অনুরাগীদের প্রিয় কণ্ঠ। ভাষার বেড়াজাল পেরিয়ে শ্রোতারা সুরেলা কণ্ঠকে, গায়কিকে আপন করে নেন। দেখেন না গায়ক কোন ভাষার মানুষ! ঠিক সেভাবেই মুকেশকে আপন করে নিয়েছেন বাঙালি শ্রোতারা। অবাঙালি মুকেশও হয়ে উঠেছেন বাংলা ও বাঙালির এক প্রিয় কণ্ঠের মালিক। যে ভালোবাসায় কোনো কমতি নেই আজও..