তেরোর গেরোয়, তেরো শতকে তুর্কি আক্রমণের মধ্য দিয়ে বাংলায় ইসলামের অনুপ্রবেশ ঘটল। আক্রমণ করলেন তুর্কি যোদ্ধা বখতিয়ার খিলজি। সেকালের গৌড়বঙ্গের বৃদ্ধ হিন্দু রাজা লক্ষণ সেন আক্রমণের সংবাদ পেয়েই রাজপাট ছেড়ে নিজের প্রাণ বাঁচাতে প্রজাদের বিপদে ফেলে সপরিবারে গোপনে পালিয়ে গেলেন পদ্মা পারে, পুব-বাংলায়। ফলে, সহজেই বাংলায় ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠিত হল। সাধারণ মানুষ মুখোমুখি হল নতুন একটি ধর্মের, যার নাম, 'ইসলাম ধর্ম'।
নতুন শাসন ও ধর্ম নিয়ে চলল বেশ কিছুদিন অরাজকতা। চলল ধর্মান্তরিত করার গা-জোয়ারি চেষ্টা। আবার হিন্দু সমাজের অবহেলিত কিছু সম্প্রদায় নতুন ধর্মে যোগ দিলেন আত্মসম্মান ফিরে পাবার আশায়। কেউ কেউ আবার ধর্মান্তরিত হল রাজপদের লোভে। বহিরাগত ও ভূমিপুত্রদের সম্মিলনে বহু বছরের সহাবস্থানে ইসলাম বাংলার একটি বিশিষ্ট ধর্ম হয়ে উঠল। ইসলাম বাংলাকে দিল তার স্থাপত্য, হস্তশিল্প, ব্যঞ্জন সংস্কৃতি, মহরম ও ঈদের মতো শোক ও আনন্দের উৎসব। আর বাংলা ইসলামকে দিল, 'জারি গান'। লোকসঙ্গীতে সংযোজিত হল নতুন এক ধারা। নতুন এই ধারাটির জন্ম হল পনেরো থেকে সতেরো শতকের কোন এক সময়। 'জারি' শব্দটি ফারসি ভাষা থেকে এসেছে, যার অর্থই হল, 'শোক'। বাংলা তাকে যুক্ত করল গান, নাচ ও অভিনয়ের সঙ্গে।
জারি গানের মূল বিষয়ই হল, মহরমের শোক। তাই নিয়েই গাথা। তবে, এ বিষয়ে আলোচনার আগে চলুন মহরম পর্বের উৎস খুঁজি। মহরম হল, ইসলামি চান্দ্র মাসের প্রথম মাস। এই মাসের দশ তারিখে কারবালায় ইমাম হোসাইন ও তাঁর পরিবারসহ দুশো সঙ্গীকে জলপান থেকে বঞ্চিত করে নৃশংসভাবে অবরুদ্ধ করে অন্যায়ভাবে হত্যার যে করুণ স্মৃতি, তাই রোমন্থন করে সেই যুদ্ধের পুনরাভিনয় ও আত্মনির্যাতনের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয় মহরম পর্ব। এর সঙ্গে হিন্দুধর্মের গাজনে চড়ক ও ভক্তদের বেতের লাঠি নিয়ে যুদ্ধাভিনয়ের মিল আছে। ইতিহাস বলছে, কারবালার যুদ্ধের আগেও মহরম পর্ব পালিত হত, তবে তা ছিল আনন্দের উৎসব। কবি জসীমউদ্দীন তাঁর একটি লেখায়, সেই ইতিহাস ও উৎসের কথা বলেছেন- 'মহরমের দশম তারিখে আশুরা উৎসব পূর্বেকার আরবদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। রসুলুল্লাহ্ বলিতেন, তোমরা এইদিনে ভালো কাজ করো; কারণ এই আশীর্বাদ-পূত মহান দিবসে হজরত আদম আলায়হিস্সালামের প্রতি খোদার দয়া বর্ষিত হইয়াছিল।' আবার ঐতিহাসিক আল্-বেরুনির লেখা থেকে জানা যায়, 'হোসেনের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মুসলমানেরা এই দিবসে আনন্দ-উৎসব উদযাপন করিত।' সেই আনন্দ উৎসব কারবালায় ইমাম হোসাইনের নিষ্ঠুর হত্যার পর পরিণত হয় বিষাদ উৎসবে :
"তরাও নিজগুণে নিজের অধীনে
বরকত-জননী, মা আমার!
পড়ে ভবঘোরে ডাকি বারে বারে, মা তোমায়--
ওগো, রসুলের মেয়ে,
ইমাম হোছেনের মা হয়ে, হলে জগৎ-মা,
তোমার ইমাম হোছেন কাঁদে,
জামা দিলে পিঁন্দে, পুত্র ব'লে তায়,
ওমা, খুশী হয়ে মনে, যেয়ে সেই ময়দানে,
ইদের নামাজ করিল আদায়।"
('বাংলার লোকসাহিত্য'-তৃতীয় খণ্ড-আশুতোষ ভট্টাচার্যকৃত সংকলন থেকে এই জারি গানটি নেওয়া)।