মল্লদের কুলদেবী মৃণ্ময়ী মায়ের মন্দির

বিষ্ণুপুর মানেই মল্লরাজাদের কীর্তির অপরূপ নিদর্শন। মন্দিরের জনপদ বিষ্ণুপুর, সঙ্গে বালুচরি, স্বর্ণচরী শাড়ি, মতিচুর, দশাবতার তাস; সব মিলিয়ে ইতিহাসের অনন্য নজির। এখানের এক বিচিত্র মন্দির হল মৃন্ময়ীমাতার মন্দির। মল্লরাজ জগতমল্ল ৯৯৭ সালে স্বপ্নাদেশ পান। সেই মতোই গঙ্গামাটি দিয়ে মৃন্ময়ীমাতা ও তার মন্দির নির্মাণ করেন। আজও অষ্টমীতে তোপধ্বনিতে দেবীর পুজো শুরু হয়। গুমগড় থেকে পাশ দিয়ে খানিক এগিয়ে উত্তরমুখী মৃন্ময়ীমাতার মন্দির। ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে বা ৪০৪ বঙ্গাব্দে, ৩০৩ মল্লাব্দে রাজা জগত্‍ মল্ল বিষ্ণুপুরে মন্দির তৈরি করে মা মৃণ্ময়ীর মূর্তি স্থাপন করলেন। মা মৃণ্ময়ীই হলেন মল্ল রাজপরিবারের কুলদেবী। তিনিই দুর্গতিনাশিনী দুর্গা, তাঁর আরাধনার মধ্যে দিয়েই মল্ল রাজপরিবারের দুর্গাপুজোর শুরু।
 
তখন থেকেই আজও রাজা জগৎ মল্লের তৈরি দুর্গা মন্দিরে প্রতি বছর একই মূর্তিতে দুর্গাপুজো চলেছে৷ মায়ের স্বপ্নাদেশে দেবী মূর্তির অঙ্গরাগ হয়। যে বছর মা স্বপ্নাদেশ দেন, সেই বছরে মৃণ্ময়ী দেবীর মূর্তি রঙ করা হয়৷ মল্লরাজবাড়ির আঠারো-উনিশ দিন ধরে দুর্গাপুজো চলে। জিতাষ্টমীর দিন থেকে জীমূতবাহন পুজোর পবিত্রলগ্নে রাজবাড়ির দুর্গাপুজো আরম্ভ হয়৷ পরের দিন কৃষ্ণানবমী তিথিতে দেবীর কল্পারম্ভ হয় অর্থাৎ মায়ের বেলবরণ অনুষ্ঠান হয়৷ 
 
৬৯৪ সালে, ১০১ বঙ্গাব্দে বাঁকুড়া জেলার প্রদ্যুম্নপুরে রাজা রঘুনাথ মল্ল, মল্ল রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন৷ মল্ল শব্দের অর্থ বাহুযু‌দ্ধে পারদর্শী ব্যক্তি৷ রাজ্যটির নতুন হয় মল্লভূম৷ মল্ল বংশের আদিপুরুষ হিসাবে রঘুনাথ 'আদিমল্ল' নামে পরিচিত। ৯৯৪ সালে মল্ল বংশের ১৯তম রাজা জগৎ মল্ল প্রদ্যুম্নপুর থেকে বিষ্ণুপুরে মল্লভূমের রাজধানী স্থানান্তরিত করেন৷ রাজা জগৎ মল্ল এক দৈববাণী অনুযায়ী মাটি খুঁড়ে এক দেবীমূর্তির মুখমণ্ডল পেলেন৷ দেবীর ইচ্ছানুসারে ওই মুখমণ্ডলটি মাটির প্রতিমার অন্তরালে ঢাকা রেখে গঙ্গামাটি দিয়ে এক দুর্গামূর্তি গড়ালেন৷ দেবীর নাম হল মৃণ্ময়ী৷​
 
এই মা মৃন্ময়ী দেবীর সঙ্গেই পটে আঁকা আরও তিন দুর্গার পুজো হয় এখানে৷ তাঁরা হলেন বড় ঠাকুরানি, মেজো ঠাকুরানি ও ছোট ঠাকুরানি৷ তিনটি পট দেখতে প্রায় অনুরূপ হলেও, এঁদের বেশভুষায় ফারাক স্পষ্ট। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, লক্ষ্মীবিলাস শাড়ি পরেন বড় ঠাকুরানি, মেজো ঠাকুরানির পরেন লাল রঙের শাড়ি আর ছোট ঠাকুরানির কমলা রঙের শাড়ি পরিহিতা৷ সেই প্রাচীনকাল থেকেই বংশপরম্পরায় ফৌজদার পরিবার এই পটগুলো এঁকে আসছেন৷ জিতাষ্টমীর পরের দিন অর্থাত্‍ কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথিতে কৃষ্ণবাঁধে স্নান করিয়ে দুর্গামন্দিরে বড় ঠাকুরানিকে নিয়ে আসা হয়৷ ওইদিনই মৃন্ময়ী দেবীর মন্দিরে নবপত্রিকার পুজো করা হয়৷ শারদীয়া চতুর্থীর দিন মেজো ঠাকুরানির পট দুর্গামন্দিরে নিয়ে আসা হয়৷ ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যায় রাজপুরোহিত শোভাযাত্রার মাধ্যমে ছোট ঠাকুরানির পট শ্যামকুণ্ডে নিয়ে যান৷ সেখান থেকে বেলতলায় পুজো করে ছোট ঠাকুরানির পট দুর্গামন্দিরে স্থাপন করা হয়৷
অষ্টমীর দিন সকালে মল্লরাজবাড়ির বিশালাক্ষী দেবীমূর্তিকে দুর্গামন্দিরে নিয়ে এসে মেজ ঠাকুরানির সামনে একটি রুপোর থালার ওপর রাখা হয়৷ মহাষ্টমী ও মহানবমীর সন্ধিক্ষণে কামানে তোপ দেগে সন্ধিক্ষণের পুজো শুরু হয়৷ মহাদণ্ড উপাধিধারীরা বংশানুক্রমে আজও পুজোয় কামান দাগেন৷ রাজবাড়ির তোপধ্বনির শব্দ কানে এলে তবেই সারা বিষ্ণুপুর শহরের সব পুজোমণ্ডপে সন্ধি পুজো শুরু হয়। মহানবমীর নিশিতে দুর্গামন্দিরে মহামারীর অধিষ্ঠাত্রী খচ্চরবাহিনী দেবীর পুজো হয়৷ দেবীর মূর্তি পটে আঁকা, রাজবাড়িতে এই পট গোপনে রাখা থাকে৷ বহু বছর আগের আঁকা এই পটে দেবী কী রূপ বিরাজ করছেন, তা খুলেও দেখা হয় না৷ নবমীর গভীর রাতে রাজবাড়ি থেকে দুর্গা মন্দিরে পট এনে পুজো করা হয়৷ রাজপুরোহিত পটের দিকে পিছন ফিরে বসেন এবং বাম হাতে পুজো করেন৷ সেই সময় শুধুমাত্র রাজা ও রাজপুরোহিত ছাড়া মন্দিরে আর কেউ থাকেন না৷ জনশ্রুতি রয়েছে, যে পুরোহিত এই পুজো করেন তিনি নির্বংশ হন৷ পুজো শেষ হলে ওই রাতেই পটটিকে রাজবাড়ির অন্দরমহলের গোপনকক্ষে নিয়ে গিয়ে রেখে দেওয়া হয়৷ বিজয়া দশমীর সকালে নবপত্রিকাকে গোপালসায়রে বিসর্জন দেওয়া হয়৷ দেবীমূর্তি বা কোন পট বিসর্জন দেওয়া হয় না৷ নবপত্রিকার মধ্যে থাকা ধান ও মান গাছকে খুলে রেখে বিসর্জন দেওয়া হয়৷
 
দশমী থেকে দ্বাদশী পর্যন্ত এখানে তিনদিন যাবৎ রাবণ কাটা উৎসব চলে৷ হনুমান, সুগ্রীব, জাম্বুবান, বিভীষণের মুখোশ ও লোমের পোশাক পরে সারা বিষ্ণুপুর শহরজুড়ে চারজন মানুষ সারাদিন ধরে নেচে ঘুরে বেড়ান৷ সঙ্গে বাজনদারও থাকেন। দশমীর দিন রঘুনাথ জির মন্দিরে রাম, লক্ষ্মণ, সীতার পুজোর পর মুখোশ নাচের অভিষেক হয়৷ দশমীতে কুম্ভকর্ণ বধ উৎসব, একাদশীতে ইন্দ্রজিৎ বধ উৎসব এবং সবশেষে দ্বাদশীর রাতে রাবণ বধ উৎসব উদযাপিত হয়। মল্লরাজবাড়িতে সব মিলিয়ে উনিশ দিনের দুর্গোৎসবের চলে৷

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...