'ক্যালকাটা, মাই এলডোরাডো'/ 'কলকাতা, আমার কল্পিত স্বর্ণভূমি' -১৯৯০ সালে এ নামেই সিটি লাইফ সিনে-সিরিজের একটি পর্বের কাজ করেছিলেন তিনি। আর ৭'এর দশকে 'পদাতিক'-এর মুখ চিরে বলেছিলেন- "ফিরে ফিরে যতবার কলকাতায় আসি, যতবার... মনে হয় কলকাতা বোধহয় একেবারে থেমে যাবে, আর চলবে না... তবু কলকাতা চলেই চলেছে। একেকটা বছরের ফারাক, আর দেখি কলকাতা আরও দুঃসহ, আরও যন্ত্রণাময়। মনে হয় নোংরা যেন আরও বীভৎস, দারিদ্র আরও বাড়ছে, হতাশা আরও মরিয়া। যতবার কলকাতার মুখোমুখি হই, মনে হয় এ এক নারকীয় শহর, কলকাতা। যার উত্থান নেই, যার শিয়রে হয়ত বা সমূহ সর্বনাশ......"। নিজের পরিসরে এমন মর্মভেদী হয়েই বেরিয়ে আসতেন সময়ের অকুতোভয় মহীরুহ মৃণাল সেন।
আবার ব্রহ্মাণ্ড-অবস্থা বুঝে 'আমার ভুবনে' ভাসিয়ে দিয়েছেন এই কটি কথা: "পৃথিবী ভাঙছে, পুড়ছে, মানুষ ছিন্নভিন্ন হচ্ছে; তবুও মানুষ বেঁচেবর্তে থাকে মমত্বে ভালবাসায় সহমর্মিতায়।" -তাঁর এই অব্যর্থ অনুসন্ধান তিনি দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলেন প্রত্যেককে। মানুষের ভিতর ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছিলেন নির্মেদ ভাবনা। অন্ধকার অন্ধকারই হয়, তার হাহা শব্দ-অন্ধ ভাব অনুরণ করে আলোর প্রার্থনা করা ছাড়া আমাদের কোনও গতি নেই -এই অমোঘ দর্শনের উদ্বুদ্ধ ভাবই তিনি আজীবন ছড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছেপূরণ করতে চেয়েছিলেন তাঁর প্রকৃত 'এজলেস' ছবিগুলোর মধ্য দিয়ে।
১৪ মে, ১৯২৩ তাঁর জন্মদিন। পূর্ব বাংলার ফরিদপুরে জন্মেছিলেন এই 'রেবেল'। পদার্থবিদ্যার ছাত্র ছিলেন; সে তার স্পটতাই বলে দেয়। পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ভাবলেন 'কী করা যায়?'। সাউণ্ড রেকর্ডিং-এর কাজ শিখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু সিনেমার প্রতি কোনও আগ্রহ প্রথমদিকে টের পাননি। টের পেইয়েছিলেন তখনই যখন সিনেমার প্রতি প্রথম 'থিওরিটিক' আগ্রহ জন্মালো রুডলফ আর্নহেইম-এর ফিল্ম এস্থেটিক্স ও আইজেনস্টাইনের শিষ্য নীলসেনের সিনেমা 'অ্যাজ এ গ্রাফিক আর্ট' নামক বইটি পড়লেন। ফিল্ম সোসাইটিতে ছবি দেখা শুরু করেন, কিন্তু ফিল্ম সোসাইটির সদস্য হতে পারেননি অর্থাভাবে। তবে যখন সিনেমা বানাবেন ভাবেন নি সেসময় লিখতে শুরু করেছিলেন চলচ্চিত্র বিষয়ে তাত্ত্বিক ও গবেষনামূলক লেখা। বিশ্ব জুড়ে যুদ্ধ, সেই যুদ্ধের সর্বব্যপী ফলাফল, মন্বন্তর, দাঙ্গা, ভাঙাভাঙি, বিদেশের নব্য তরঙ্গ আন্দোলন - এসবকিছু যখন ঘটে চলেছে, শিক্ষা-সংস্কৃতি-বিচার-বোধ দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফেলেছে ততক্ষণে; ঝাঁঝিয়ে উঠেছে তাঁর মাথা, বিস্ফোরণ বেদনা আর স্পর্ধায় গড়া চলমান চিত্রভাষাকে তুলে ধরবেন এ জগৎসংসারে, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন মৃণাল সেন।
১৯৫৫ -তে 'রাতভোর' বানালেন, ব্যর্থ ছবি; নিজেও স্বীকার করলেন, 'জঘন্য ছবি'। ১৯৫৯-এ 'নীল আকাশের নীচে'; সর্বব্যাপী আত্মীয়তাবোধের ইঙ্গিত তুলে ধরল সেই ছবি, সফলতা পেলেন কিছুটা। ১৯৬০-এ 'বাইশে শ্রাবণ'; সমাজ ও সময়-যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষ মানুষের মধ্যে সম্পর্কবোধে-মূল্যবোধে যে পরিবর্তন ঘটিয়ে ছিল তা দেখিয়েছিলেন, শুধু তাই নয় সমালোচকদের মতে এদেশে এই ছবিটিতেই সম্ভবত নারীমুক্তির প্রসঙ্গ প্রথম প্রকৃত অর্থে ধরা পড়ে। ১৯৬১-তে 'পুনশ্চ'; বাইশে শ্রাবনেরই পরবর্তী পর্যায় বলা চলে ছবিটিকে। ১৯৬২-তে 'অবশেষে'; স্বামী স্ত্রী'র সম্পর্ক, বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে নানা শ্লেষ ও কমেডি ধরা পরেছে ছবিটিতে। ১৯৬৪-তে 'প্রতিনিধি'; এ ছবির বিষয় পুরুষশাসিত সমাজে মেয়েদের অবস্থা। ১৯৬৫-এ 'আকাশ কুসুম'; পেটি-বুর্জয়া ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলেন এবং শৈলী-আঙ্গিক নিয়ে পরিক্ষানিরীক্ষা করেন। ১৯৬৬-তে 'মাটির মনিষ'; ওড়িয়া ভাষায় তৈরী, কালিন্দীচরণ পাণিগ্রাহীর গল্প। ১৯৬৭-তে 'মুভিং পারর্স্পেকটিভ'; তথ্যচিত্র, বিষয়- ভারতীয় ইতিহাসের পাঁচ হাজার বছর। ১৯৬৯-এ ভুবন সোম। হিন্দীতে তৈরী-বনফুলের কাহিনী-ধারাভাষ্যে ছিলেন অভিতাভ বচ্চন, হিন্দী ছবির ক্ষেত্রে প্যারালাল সিনেমার সূত্রপাত হয়। ১৯৭০-এ 'ইচ্ছাপূরণ'; রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প অবলম্বনে তৈরি, শিশুচিত্র হলেও অনেকের মতে ছবিটি শিশুদের পক্ষে কঠিন। সত্তরের দশকের কলকাতার নকশালবাড়ি আন্দোলনের রসায়নে তাঁর ট্রিলজি, 'ইন্টারভিউ(১৯৭১)-ক্যালকাটা ৭১ (১৯৭২)-পদাতিক (১৯৭৩)। ১৯৭২-এ বানিয়েছিলেন আরও একটি ছবি 'এক আধুরী কাহানি', সুবোধ ঘোষের 'গোত্রান্তর' অবলম্বনে তৈরী। ১৯৭৪-এ 'কোরাস'। ১৯৭৬- 'মৃগয়া'। ১৯৭৭ 'ওকা উরি কথা'। ১৯৭৮-'পরশুরাম'। ১৯৭৯-এ 'একদিন প্রতিদিন। ১৯৮০-তে 'আকালের সন্ধানে'। ১৯৮১-তে 'চালচিত্র'। ১৯৮২-তে 'ত্রিপুরা প্রসঙ্গ'। ১৯৮৩-তে 'খারিজ'। ১৯৮৪-তে 'খণ্ডহর'। ১৯৮৫-তে 'তসবীর আপনি আপনি'। ১৯৮৬-এ 'জেনেসিস'। ১৯৮৭-তে 'কভী দূর কভি পাস'। ১৯৮৯-তে 'একদিন আচানক'। ১৯৯১-এ 'মহাপৃথিবী'। ১৯৯৩-এ 'অন্তরীণ'। ২০০২-এ 'আমার ভুবন'।
প্রায় পাঁচ দশক ধরে তিনি শুধুমাত্র বাংলা নয়, সমগ্র দেশের চলচ্চিত্র ভাবনাকে সমৃদ্ধ করেছেন। উপমহাদেশের চলচ্চিত্র ভাবনায় রাজনৈতিক সচেতনতার আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন তিনি। ছাত্রাবস্থায় যুক্ত হয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক শাখা 'গণনাট্য সংঘ'-এর সঙ্গে। কখনও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হননি। তিনি নিজেকে একজন 'প্রাইভেট মার্ক্সিস্ট' বা 'ইন্ডিভিজুয়াল মার্ক্সিস্ট' বলতেন। বের্টোল্ড ব্রেখটের এপিক থিয়েটার এলিয়েশন এফেক্ট তত্ত্ব তাঁর শিল্পভাবনায় স্থান পেয়েছিল। যেমনভাবে, চলচ্চিত্রে ব্রেখটিয়ান ভাবনা প্রক্সুক্ত করার প্রেরণা পেয়েছিলেন প্যারিসের নিউ ওয়েভ বা ন্যুভেল ভাগ ফিল্ম মুভমেন্টের জঁ লুক গোদার, ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো ও ক্লদ শ্যাব্রলদের থেকে, তেমনভাবেই সাহস ও অনুপ্রেরণা পেতেন সমসাময়িক সমমনস্ক বন্ধু বিজন ভট্টাচার্য, ঋত্বিক ঘটক -এঁদের থেকে। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তাঁর গলায় গলায় ভাব না থাকলেও, একে অপরকে সমীহ করতেন দু'জনেই। তিনি থিসিস এবং অ্যান্টিথিসিস-এর সমন্বয় ঘটাতেন তাঁর চলচ্চিত্রে। বারংবার ফ্রিজ শটের ব্যবহার করে চিত্রনাট্যের সাধারণ কাঠামোকে ভেঙে দিয়েছিলেন। সিনেমায় ব্যবহার করতেন গণসংগীত, ধ্রুপদ ও এক্সপেরিমেন্টাল যন্ত্রসঙ্গীত। ক্রমাগত নিরীক্ষা এবং অনুশীলনের মধ্য দিয়ে সিনেমার ইতিহাসে সাবলীল পথ প্রশস্ত করেছেন তিনি। তাঁর এই সৃষ্টিশীল পথ চলায় সামিল করতে চেয়েছিলেন বিশ্বদর্শকদের। গত ডিসেম্বরে ৯৫ টি বছর মহাপৃথিবীতে কাটিয়ে জীবনকে খারিজ করে আকালের সন্ধানে চলে গেছেন সেই পদাতিক। অবিচুয়ারি-হাহাকার-চলে যাওয়া নিয়ে চিন্তার কারণ আছে বলে মনে হয়না...কারণ, অতিক্রান্ত ইতিহাস খননে প্রজন্মের জিজ্ঞাসাকে সঠিক ধারনা দিতে তিনি অভিভাবকের মতো রেখে গিয়েছেন তাঁর প্রজ্ঞা-মুক্ত বাতাস-কয়েক দশকের সিনেমা সম্পদ-অকুতোভয়তা।