'বালিকা বধূ'তে মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়ের আবির্ভাব কাহিনি

সে একটা সময় ছিল বটে; যখন পথে-ঘাটে, বাসে-বাসস্টপে সঙ্গীত-নাটক-সিনেমার প্রতিভা আবিষ্কৃত হত। লম্বা লম্বা লাইনের অডিশন, অমুকের রেফারেন্স, তমুকের চিঠি ইত্যাদি ব্যাপারগুলো যখন এই শিল্পলোকের মজ্জায় বাসা বাঁধেনি; সে-সময়ই একদিন অভিনেত্রী মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়কে পথেই আবিষ্কার করেছিলেন পরিচালক তরুণ মজুমদার।

গত শতকের ছয়ের দশকের মাঝামাঝি। ইতোমধ্যে সাহিত্যিক বিমল করের লেখা বেশ মজার একখানা বড়গল্প ‘বালিকা বধূ’ অবলম্বনে পরিচালক তরুণ মজুমদারের চিত্রনাট্য লেখা হয়ে গেছে। বাল্যবিবাহ এই গল্পের কেন্দ্রীয় ঘটনা। কাজেই কেন্দ্রীয় চরিত্রের বালিকা বধূর চরিত্রে নিষ্পাপ-সরল অথচ সপ্রতিভ একটি কিশোরী মেয়ের প্রয়োজন। তরুণ এবং তাঁর সাগরেদরা খোঁজ চালাচ্ছেন, কিন্তু মনের মতো কাউকে পাচ্ছেন না।

তরুণ মজুমদারের মতো পরিচালকেরা গল্পের প্রয়োজনে মুখ খোঁজেন, মুখের জন্য গল্প নয়। তাই দীর্ঘ সময় ধরে মনের মতো অর্থাৎ গল্পের সঙ্গে মানানসই মুখটি না-পাওয়ায় চিত্রনাট্য, প্রযোজক, ইউনিট সমস্তই প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও ছবির শ্যুটিং আটকে আছে।এরকম অবস্থায় টালিগঞ্জের বুকে স্টুডিও পাড়ায় ছোট্ট একটি ঘটনা ঘটে গেল একদিন…

টালিগঞ্জের বিখ্যাত এন.টি-ওয়ান স্টুডিওর গায়েই একটি ফ্ল্যাটে তখন তরুণ মজুমদারের বাসা। আর তারই কাছাকাছি নৃপেন্দ্রনাথ গার্লস হাইস্কুল। সেদিন বিকেলে তরুণ মজুমদার অর্থাৎ তনুবাবু বাসা থেকে বেরিয়ে কী একটা কাজে স্টুডিও যাচ্ছিলেন। তখন সবে স্কুলছুটির ঘন্টা পড়েছে। মেয়েরা হুড়মুড়িয়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে কাছাকাছি যাদের বাড়ি, তারা বাড়ির দিকে হাঁটা দিতে শুরু করেছে। তাদের ভিড় পেরিয়ে তনুবাবু স্টুডিওর গেটে পৌঁছতেই প্রায় সামনে পড়ে গেলেন এক কিশোরীর। হঠাৎ তার মুখের দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠে থমকে গেলেন তিনি। আরে, এই মেয়েকেই তো খুঁজছিলেন এতদিন! এ মেয়েই তো তাঁর কল্পনার ‘বালিকা বধূ’! ভাবনার এই টুকরো মুহূর্তেই গেট ছাড়িয়ে চটপটে মেয়েটি এগিয়ে গেছে খানিকটা। সম্বিত ফিরতেই তনুবাবু গেটের দারোয়ানকে বললেন ডেকে আনতে।

মেয়েটি সত্যই সপ্রতিভ। তনুবাবু দেখলেন। দারোয়ান তাকে ডাকতেই, সহজেই সে এল। তনুবাবু তাকে নাম জিজ্ঞেস করতে, সরল-নিষ্পাপ মুখে বলল, ‘ইন্দিরা’। তনুবাবু ‘সিনেমায় কাজ করবে?’ জিজ্ঞেস করতেই মিষ্টি কণ্ঠে অবলীলায় মেয়েটি বলল, ‘হ্যাঁ করব’। মেয়েটিকে বেশ লাগল তনুবাবুর। মন বলল, এই মেয়েকেই চাই, এ-মেয়ে না-হলে ছবিটাই হবে না! মেয়েটির ঠিকানা আর বাবার নাম লিখে নিয়ে তনুবাবু তাঁকে বাড়ি যেতে বললেন। মেয়েটিও বেশ সপ্রতিভ মাথা নেড়ে চলে গেল।

তনুবাবুর বাড়ি থেকে ইন্দিরাদের বাড়ি খুব বেশিদূর না। এন.টি-ওয়ান ছাড়িয়ে খানিকটা সামনে এগোলেই ‘ক্যালকাটা মুভিটোন’ স্টুডিও, তার ঠিক পেছনেই তাদের বাড়ি। ইন্দিরাকে অমন সরল সরল দেখতে হলে হবে কী, আসলে কিন্তু বেশ ডানপিঠে। বাড়ি পালিয়ে স্টুডিওর দেওয়াল টপকে কত কত বার সে সিনেমার শ্যুটিং দেখেছে। উত্তম কুমার, বিশ্বজিৎ-এর মতো নায়কদের একেবারে কাছ থেকে দেখেছে। তাই ছায়াছবিতে কাজ করার কথা শুনে তার একটুও ভয় হয়নি। বারে বারেই মনে হয়েছে, ও আর এমন কী হাতিঘোড়া! তাই অত সহজেই সে তনুবাবুর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যেতে পেরেছে। 

যাই হোক, এদিকে ইন্দিরার কথা শুনে তনুবাবু বেশ আশায় আশায় বুক বেঁধেছিলেন। তাই শিগগির একদিন তাঁদের বাড়ি গিয়ে ইন্দিরার বাবার সঙ্গে দেখা করলেন। ভদ্রলোকের নাম, প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায়। আগে আর্মিতে চাকরি করতেন, এখন করেন রেলে। প্রাণতোষ মানুষটা খুব ভালো। স্টুডিওপাড়ায় বাড়ি হলেও ছায়াছবির জগতটা ঠিক পছন্দ করেন না। কানাঘুষোয় এই আলোয় ঢাকা অন্ধকার জগতের অনেক গল্প তিনি শুনেছেন। তাই তনুবাবুর প্রস্তাবে তাঁর পক্ষে রাজি হওয়া সম্ভব হল না। তবে তাঁকে দেখে তনুবাবুর একেবারে কাঠ একরোখা মনে হল না। তাই হতাশ হলেও হাল ছাড়লেন না।

কাজেই অভিনয়ের প্রস্তাবটি ক’দিন পর পরই বিভিন্ন লোকের মারফৎ পাঠাতে লাগলেন। তারাও প্রাণতোষকে ইনিয়ে বিনিয়ে নানাভাবে রাজি করানোর চেষ্টা করলেন; কিন্তু নাহ, কোনভাবেই চিঁড়ে ভিজল না। শেষমেশ একদিন খোদ সন্ধ্যা রায়কেই তাঁদের বাড়িতে পাঠালেন তনুবাবু।

সন্ধ্যা রায় যখন বাড়িতে এলেন, তখন প্রাণতোষ বাড়িতে ছিলেন না। অফিস গিয়েছিলেন। সন্ধ্যা একটা চিরকুটে ঠিকানা লিখে দিয়ে এলেন, অনুরোধ জানিয়ে এলেন; তিনি ফিরলে যেন তাঁদের বাড়িতে একটিবার অন্তত গিয়ে দেখা করেন। প্রাণতোষ অফিস থেকে ফিরে সব শুনলেন। সন্ধ্যা যেহেতু বাড়ি বয়ে অনুরোধ করে গেছেন, তাই মন্দিরা ও ইন্দিরা—দুই মেয়েকে নিয়ে সন্ধ্যেবেলায় তিনি সন্ধ্যার বাড়ি গেলেন।

প্রাণতোষ তনুবাবু ও অন্যান্যদের যা বলেছেন, সন্ধ্যাকেও তা বললেন। সিনেমাজগত সম্পর্কে তাঁর ভয়ের কথাও বললেন। জানালেন, তিনি চান না তাঁর মেয়ে এই জগতে আসুক। সন্ধ্যা তবুও হাল ছাড়লেন না। প্রাণতোষকে বোঝালেন, ইন্দিরার ভালোমন্দ সব দায় তাঁর, তিনি শুধু এ-ছবিটা করতে অনুমতিটুকু অন্তত দিন, এ ছবি তাঁর, তনুবাবুর অনেকদিনের স্বপ্ন…

এই অনুরোধের পর প্রাণতোষ আর না-করতে পারেননি।

Mousumi-Balika-Badhu

তনুবাবুর শিক্ষায়, সন্ধ্যা রায়ের সাহচর্যে; সেদিন এক অভিনেত্রীর জন্ম হল। জন্ম হল আর এক স্টারের। ভালমন্দের সব দায়িত্ব ওভাবে নেওয়াটা কম কথা ছিল না। এ-দায়িত্ব সবাই নেয় না। নিতে পারেও না। তনুবাবুরা নিয়েছিলেন, তাই সিনেমাজগত এক দুর্দান্ত অভিনেত্রীকে পেয়েছে। তাঁরা না-হলে হয়তো সম্ভব হত না। ইন্দিরাকে সর্বক্ষণ নিজের কাছে রেখে, তার সমস্ত চপলতাকে, ডানপিঠেমিকে সহ্য করে, কখনও প্রশ্রয় দিয়ে তার কাছ থেকে তাঁরা ভালো কাজ আদায় করে নিয়েছিলেন। বিগত পঞ্চাশ বছরে তনুবাবুর হাত দিয়ে অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী তৈরি হয়েছে, তিনি হীরে খুঁজে খুঁজে বাংলা সিনেমাকে অনেক স্টার উপহার দিয়েছেন, তার মধ্যে ইন্দিরা অন্যতম।

যাই হোক, একদিন ‘বালিকা বধূ’র শ্যুটিং শেষ হল। মুক্তি পেল। মুক্তি পেতেই চারিদিকে একেবারে সাড়া পড়ে গেল। হলে হৈ হৈ করে চলতে লাগল ছবি। এই ছবির মধ্য দিয়ে ইন্দিরা ‘মৌসুমী’ নামে সকলের হৃদয়ে জায়গা করে নিলেন।  ছায়াছবিতে অভিনয় করতে এসে অনেক নায়ক-নায়িকারই নামপরিবর্তন হয়েছে বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমায়। এও একটা ইতিহাস। আর তাঁদের অধিকাংশেরই নাম পরিবর্তন করেছেন স্বয়ং পরিচালক। কিন্তু ইন্দিরার ‘মৌসুমী’ নামটি ‘বালিকা বধূ’র পরিচয়লিপিতে প্রথম ব্যবহৃত হলেও তা কিন্তু তনুবাবুর দেওয়া নয়।আসলে, মেয়ের ‘ইন্দিরা’ নামটি প্রাণতোষ দিয়েছিলেন। ভালোবেসে ডাকতেন, ‘ইন্দু’ বলে। ইন্দিরা মিষ্টি অথচ ডানপিঠে স্বভাবের ছিলেন বলে একদিন ভূগোলে বৃষ্টিবাহক ‘মৌসুমী বায়ু’ সম্পর্কে পড়তে পড়তে দিদি মন্দিরা তাঁর নাম রেখেছিলেন, ‘মৌসুমী’। নায়িকার নাম হিসেবে ‘ইন্দিরা’ নামটি তনুবাবুর পছন্দ হয়নি, তাই ইন্দিরার কাছে এই দ্বিতীয় নামটির খোঁজ পেয়ে তাকেই ছবির পরিচয়লিপিতে স্থান দিয়েছিলেন। তাই ইন্দিরা সেদিন মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় নামেই সুবিখ্যাত হয়েছিলেন।

Mousumi-Chatterjee

বাংলার উত্তমকুমার থেকে শুরু করে বলিউডের অমিতাভ বচ্চন—সমসময়ের প্রায় সব বড় বড় স্টারের বিপরীতেই মৌসুমী অভিনয় করেছেন। অভিনয় দিয়ে তিনি আজও ঋদ্ধ করে চলেছেন ভারতীয় সিনেমার ধারা। তাঁর প্রথম বাংলা ছায়াছবি ‘বালিকা বধূ’র প্রিন্ট নষ্ট হয়ে গেছে, ছবিটি চিরতরে হারিয়ে গেছে; কিন্তু বয়সের পরত পেরিয়ে আপামর দর্শক হৃদয়ে তিনি আজও মৌসুমীবায়ুর মতোই এক প্রাণোচ্ছল কিশোরী হয়ে প্রাণবন্ত অভিনয় নিয়ে রয়ে গেছেন মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়…

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...