মাতৃভাষা ও শ্রী অরবিন্দ

'বিনে স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা'--কথাটা যদি প্রাণের কথা হয়, তাহলে তা ছিল শ্রী অরবিন্দ ঘোষের প্রাণের কথা। শৈশব থেকে যৌবন তিনি বিলেতে কাটিয়েছেন। সেখানে মাতৃভাষা শেখার তেমন সুযোগ পাননি। তবে, তিনি কিন্তু বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষায় সুপণ্ডিত হয়ে উঠেছিলেন। নানা ভাষা শেখার অদম্য ইচ্ছে তাঁর মধ্যে আবাল্য লালিত হয়েছে। সিভিল সার্ভিসে ল্যাটিন ও গ্রিক ভাষার পরীক্ষায় এত বেশি নম্বর পেয়েছিলেন যে, খাস বিলিতিরাও কোনদিন অত নম্বর পায়নি। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি প্রচুর বই পেয়েছিলেন প্রাইজ হিসেবে। বিভিন্ন ভাষা সম্বন্ধে তাঁর শ্রদ্ধা ও শেখার আগ্রহ ছিল প্রবল। ফলে, কালে কালে ফরাসি, জার্মান, রাশিয়ান, গ্রিক, ল্যাটিন, হিব্রু প্রভৃতি ভাষার কাব্য-উপন্যাস-ইতিহাস-দর্শনের অজস্র বইয়ে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল তাঁর বিস্তৃত পাঠাগার। 

অরবিন্দ বিলেত থেকে দেশে ফিরলেন যৌবনবেলায়। অধ্যাপনার কাজ নিলেন মারাঠারাজ্য বরোদায়। দেশে ফিরলেন, কিন্তু আর পাঁচজনের মতো সঙ্গে করে বিলিতিয়ানার পরসজ্জা বয়ে আনলেন না। ধারণ করলেন স্বদেশি-পোশাক--আমেদাবাদ মিলের মোটাপাড়ওয়ালা খাদি, মোটা মেরজাই আর পায়ে দিলেন শুঁড়তোলা সেকেলে নাগরা। রাখলেন ঘাড় অব্দি বাবরি চুল, মাঝে করলেন সিঁথি।

বরোদায় কাজে এলেন বটে, কিন্তু তাঁর নতুন নতুন ভাষা-শিক্ষায় কামাই হল না। এখানে এসে অল্পদিনেই শিখে ফেললেন সংস্কৃত। পাঠ শুরু করলেন, 'রামায়ণ'। তারপর, 'মহাভারত'। পাঠ করে তাঁর মনে হল মহাভারতের বিচিত্র ও মহান আখ্যানমালার ইংরেজি কাব্যরূপ দিতে হবে। এসব কাজ ফেলে রাখা তাঁর ধাতে ছিল না। ফলে, শুরু হল রচনার কাজ। তারই মাঝে তিনি এলেন কলকাতায়। দেখা হল মাতৃপক্ষের দাদু রাজনারায়ণ বসুর সঙ্গে। বেরিয়ে এলো অরবিন্দের অন্তরের খেদ--বাঙালির ছেলে হয়ে বাংলায় চিঠি লেখা তো দূরের কথা, বাংলায় ভালো করে কথা পর্যন্ত বলতে পারেন না! বিষয়টা রাজনারায়ণকেও ভাবাচ্ছিল, নাতির কথায় তিনি এমন একজন উপযুক্ত বাংলা শিক্ষকের খোঁজ করলেন, যিনি অরবিন্দের সঙ্গে বরোদা যেতে এবং সেখানে থাকতে রাজি হবেন। পুত্র যোগীন্দ্রনাথ বসুর বন্ধু সাহিত্যিক দীনেন্দ্রকুমার রায়। সাহিত্যিক হিসেবে তখন তাঁর কিছু নামডাক হয়েছে। নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ।তাঁকে হাতের কাছে পেয়ে গেলেন রাজনারায়ণ। বুঝলেন, ইনিই উপযুক্ত মানুষ। ব্যস, তাঁকে একেবারে রাজি করিয়ে তবে ছাড়লেন।

অরবিন্দর সঙ্গে দীনেন্দ্রকুমার এলেন বরোদায়। একটু দুরু দুরু বুকেই এলেন, এত বড় একজন পণ্ডিত মানুষ--তাঁকে তিনি আর কী শেখাবেন! নেহাত রাজনারায়ণের কথা ঠেলতে না পেরে তাঁর আসা। এসে, ক'দিন মিশে দেখলেন মাটির মানুষ অরবিন্দ। অন্তরে পণ্ডিত্য থাকলেও বাইরে জিজ্ঞাসু ছাত্রের ছটা। মানুষটা পুরোপুরি যেন মগ্ন জ্ঞানসাধক। তাঁর জীবনে কোন সময়ের অপচয় নেই। এরইমধ্যে অরবিন্দ একদিকে যেমন মহাভারতের সাবিত্রী-কাহিনি অনুবাদ শুরু করেছেন; অন্যদিকে তেমনি ফাড়কে পদবীধারী এক মারাঠি পণ্ডিতের কাছে মারাঠি শিখছেন। আর এক পণ্ডিতের কাছে শিখছেন 'মোরি' ভাষা। এ-ভাষা মারাঠির অপভ্রংশ। বেশ কঠিন এক ভাষা। কঠিন হোক বা সহজ নতুনের সঙ্গে পরিচিত হওয়া এবং তাকে আত্মস্থ করাতেই তো অরবিন্দের আনন্দ!

দীনেন্দ্রকুমারের তত্ত্বাবধানে এবার শুরু হল তাঁর বাংলা পাঠ। সপ্তাহে দু'একদিন কিংবা দশ-পনের দিন অন্তর এক বা দু'দিন। অরবিন্দ পণ্ডিত মানুষ তাঁর গ্রহণ করার ক্ষমতা অসীম। বেশি সময় লাগল না, অক্ষর চেনা থেকে অল্পদিনেই সাহিত্যের ঘাটে তরী ভেড়ালেন তিনি। শুরু করলেন তারকনাথের 'স্বর্ণলতা', ভারতচন্দ্রের 'অন্নদামঙ্গল', দীনবন্ধু মিত্রের 'সধবার একাদশী' পড়তে। কথোপকথনের ভাষা ভালো বুঝতে না-পারলে দীনেন্দ্রকুমার তা ইংরেজিতে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেন। কিন্তু, দীনেন্দ্রকুমারও একদিন ইংরেজি অনুবাদ করে বোঝাতে গিয়ে ফ্যাসাদে পড়লেন। হ্যাঁ, ফ্যাসাদেই পড়লেন দীনবন্ধুর 'লীলাবতী' পড়াতে গিয়ে। সেখানে একটা ছড়া ছিল এরকম :

"মদের মজাটি গাঁজা কাটি কচ কচ;

মামীর পীরিতে মামা হ্যাঁকচ-প্যাঁকচ।"

একে তো অনুবাদে ছড়াটার বাঙালি-এসেন্স বার করতে দীনেন্দ্রকুমারের দম বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড় হল, তার ওপর 'হ্যাঁকচ-প্যাঁকচ' বোঝাবেন কেমন করে! সেইসঙ্গে ব্রহ্মচারী অরবিন্দকে পিরিতের 'হ্যাঁকচ-প্যাঁকচ' বোঝানো হল আরও কঠিন!

যাই হোক, এভাবেই একদিন বাংলা শিখে ফেললেন অরবিন্দ। বঙ্কিমের উপন্যাস নিজেই পড়তে শুরু করলেন। মুগ্ধ হলেন। শুধু তাই নয়, ইংরেজিতে বঙ্কিমকে শ্রদ্ধা জানিয়ে 'সনেট'-ও লিখে ফেললেন। এসময় বাংলা সাহিত্যের নেশা যেন পেয়ে বসল তাঁকে। কলকাতা থেকে ফি-হপ্তায় পার্সেলবন্দি হয়ে আসতে লাগল রবীন্দ্রনাথের বই, বিবেকানন্দের বই, গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সনস এবং বসুমতী প্রকাশিত গ্রন্থাবলী। আসতে লাগল 'বসুমতী' পত্রিকা। এভাবে ভাবে-স্বভাবে বাঙালিয়ানার স্বাদ নিয়ে তবেই একদিন বাংলায় এলেন অরবিন্দ। বাংলার বিপ্লব-সাধনার শরিক হলেন। সেই সাধনার ইতিহাস আর এক অধ্যায়, আর এক পর্ব...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...