১৯৭০ সালে নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে 'হাজার চুরাশির মা' লিখেছিলেন মহশ্বেতা দেবী। সেখানেও ছিল এক মা আর সন্তানের কাহিনী। 'হাজার চুরাশির মা'-এর জন্য নেলসন ম্যান্ডেলা নিজে তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন 'জ্ঞানপীঠ পুরস্কার'। ভাবছেন তো মহাশ্বেতা দেবী, 'হাজার চুরাশির মা'-এর সঙ্গে আমার এই প্রবন্ধের যোগাযোগ টা কোথায়? যোগাযোগ এক্ষেত্রে মোটামুটি এইরকম- মহাশ্বেতা দেবীও তাঁর উপন্যাসে এক মা এবং সময়ের সংগ্রাম নিয়ে কথা বলেছিলেন, আর আমার এই প্রবন্ধের প্রেক্ষাপটও এক মা এবং তাঁর হাজার সন্তান নিয়ে সংগ্রামের। তবে এক্ষেত্রে শুধু নিছক বিমূর্ত 'গল্প' নয়, সত্যিকারের কিছু কথা।
নাম তার 'সালুমারাদা' থিম্মাক্কা। দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকের হুলিকাল গ্রামের একজন অতিসাধারণ নিরক্ষর নারী। শুধুমাত্র নিরক্ষরই নন; নিঃসন্তানও। একজন নারী 'গর্ভধারন'-এর মাধ্যমেই পূর্ণতা পান, আজও সমাজে এই প্রচলিত ধারনাটি এঁটে বসে রয়েছে। এই দুর্বিসহ অপবাদে সমাজ থেকে একঘরে করে দেওয়া হয় থিম্মাক্কা'কে। সমাজ-প্রবর্তিত এই প্রচলিত ধারনাকেই পাল্টে দিয়ে বর্তমানে তিনি প্রায় ৮০০০ টি গাছের মা। পরে ভালবেসে তাঁর নামের আগে 'সালুমাদারা' উপাধি দেন তাঁর গ্রামবাসীরাই, কণ্ণড় ভাষায় যার অর্থ 'গাছেদের সারি'।
থিম্মাক্কার স্বামী মারা যান অনেক বছর আগে, ১৯৯১ সালে। স্বামী মারা যাওয়ার পর অন্যরকমভাবেও নিজের জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতেন এই মহীয়সী, কিন্তু ১০৬ বছরের থিম্মাক্কা তাঁর সারাজীবনটাই উৎসর্গ করেন 'বৃক্ষসন্তান' উদ্দেশ্যে। থিম্মাক্কা ও তাঁর স্বামী চিক্কাইয়া ছিলেন ভূমিহীন দিনমজুর। কথা বলার সমস্যা থাকায় স্বামী চিক্কাইয়াকে পাড়া-পড়শিরা বলতেন 'তোতলা-চিক্কাইয়া'। সমাজ তাঁদেরকে একঘরে করে দেওয়ার পর সমাজ-বিচ্ছিন্ন থিম্মাক্কা-চিক্কাইয়া একে অপরকে আরও বেশি করে জড়িয়ে ধরেছিলেন। নিরক্ষর-দিনমজুর-গেঁয়ো থিম্মাক্কা বলেন, 'একদিন দু'জনে ভাবলাম আমরা তো গাছ লাগাতে পারি। আর ওই গাছগুলোকেই সন্তানের মমতায় বড় করে তুলতে পারি।' এরপর তাঁরা একত্রে সিদ্ধান্ত নেন সমাজের এই বঞ্চনার 'প্রতিবাদ'-এ তাঁরা লাগাবেন 'গাছ'।
সেই শুরু...১০ টি, ১৫ টি, ২০ টি, তিনবছর ধরে মোট ২০ টি বট গাছের চারাকে সন্তান স্নেহে লালন করতে থাকেন এই দম্পতি। জায়গা হিসেবে বেছে নেন নিজ বাড়ি থেকে ৪ কিলোমিটার দূরের একটি ফাঁকা জায়গা। সেখানে জলের কোনো উৎস না থাকায় প্রতিদিন বাড়ি থেকে বয়ে নিয়ে জল দিতেন গাছে। প্রাণী ও রোগের আক্রমণ থেকে গাছগুলোকে বাঁচাতেও শ্রম দেন প্রাণ ঢেলে। গাছগুলোতে শিকড় আসা পর্যন্ত চলতে থাকে এই যত্নের লালন-পালন। এভাবে তাঁরা লাগান মোট ৩৮৪টি গাছ, এমনকি তাদের দেখাশোনার জন্য দিনমজুরিও ছেড়ে দেন চিক্কাইয়া। থিম্মাক্কা একাই রোজগার করে স্বামী-'বৃক্ষ' সন্তানদের দায়িত্ব নেন।
১৯৯৬ সালে 'জাতীয় নাগরিক সম্মান'-এ ভূষিত হওয়ার পরই জনসমক্ষে আসে থিম্মাক্কা ও তাঁর জীবন সংগ্রাম। তাঁর কর্মকাণ্ডের কথা জানতে পেরে তাঁর সাহার্য্যার্থে এগিয়ে আসেন বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা। ২০১৬ সালে বিবিসি-র বিচারে বিশ্বের ১০০ জন প্রভাবশালী মহিলাদের তালিকায় নাম উঠে আসে 'সালুমাদারা' থিম্মাক্কা'র নামও। ২০১৯-এ দেশের রাষ্ট্রপতি তাঁর হাতে তুলে দিয়েছেন 'পদ্মশ্রী' সম্মান। সম্প্রতি সাংবাদিক গৌরি লঙ্কেশ খুনের প্রতিবাদেও সামিল হয়েছিলেন তিনি। জানা গেছে, গত ৮০ বছরে প্রায় ৮০০০ গাছ লাগিয়ে তাদের প্রতিপালন করেছেন তিনি। বর্তমানে ১০৬ বছর বয়সী এই 'মা'-এর প্রতিপালিত সন্তানদের দায়িত্ব নিয়েছেন কর্ণাটক সরকার। এ প্রসঙ্গে থিম্মাক্কার বক্তব্য, 'নিজের সন্তানদের নিজে প্রতিপালন করতে পারলেই সবথেকে খুশি হতাম আমি। কারণ কখনওই কারোর সাহায্য চাইনি আমরা।' পৃথিবীর এমনই এক 'বিরলতম' মা তিনি।
আজ কর্নাটকের হুলিকাল গ্রাম থিম্মাক্কার শ্যামলছায়ায় পরিবেষ্টিত। হুলিকাল থেকে পাশের গ্রাম কুডোরের দিকে যেতে যে ৫ কিলোমিটার সড়ক, তা আজ যেন সবুজের মায়াঘেরা সুড়ঙ্গ। জায়গাটা রাজধানী ব্যাঙ্গালুরু থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে। 'একঘর' কুসংস্কার-প্রথা লঙ্ঘনকারী সমাজ বিবর্তনবাদী 'হাজার গাছের মা'- থিম্মাক্কা এখন নিজেই যেন এক জীবন্ত মহীরুহ।