প্রেম, ভালবাসা এবং মানব সেবার অনন্য চরিত্র মাদার টেরেসা

প্রেম, ভালবাসা এবং মানব সেবায় মাদার টেরেসা হয়ে উঠেছেন এক অলৌকিক চরিত্র। বাবা-মা ছেড়ে, দেশ ছেড়ে, নিজের নিশ্চিন্ত জীবন ছেড়ে এই সুদূর প্রাচ্যে কলকাতায় এসে, স্বেচ্ছায় ত্যাগের জীবন বেছে নিয়েছিলেন। গ্রামে-গঞ্জে ছুটে গিয়েছেন, পিতৃ-মাতৃহারাদের কোলে তুলে নিয়েছেন, রোগী-আর্তদের সেবা করছেন, সহমর্মিতা দেখাচ্ছেন, মৃত্যুপথযাত্রীদেরকেও জীবনের মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছেন, এ তো শাশ্বত মানবপ্রেম। ভালবাসার চেয়ে বড় হাতিয়ার আর হয় না। সেই অস্ত্রেই তিনি হয়ে উঠেছেন মা। দুনিয়া তাঁকে যবে হোক সেন্ট হুড দিক, তিনি বহুদিন আগেই ভারতীয়দের জন্যে সন্ত হয়ে গিয়েছেন। মানব সেবা তাঁকে আজও অমর করে রেখেছে।
 
১৯১০ সালের ২৬ আগস্ট, অর্থাৎ আজকের দিনেই যুগশ্লোভিয়ায় অধুনা ম্যাসিডোনিয়ার রাজধানী স্কোপ্জেতে জন্মগ্রহণ করেন। প্রথমে তাঁর নাম রাখা হয়েছিল মেরি টেরেসা বোজাক্সিউ। তিনি ছিলেন তাঁর পিতা-মাতার কনিষ্ঠ সন্তান। মাত্র আট বছর বয়সে পিতাকে হারান। এরপর, মা তাঁকে রোমান ক্যাথলিক আদর্শে বড় করেন। তিনি ছোট থেকেই ধর্মপ্রচারকদের জীবন ও কাজকর্মের গল্প শুনতে ভালবাসতেন। ১২ বছর বয়সেই সন্ন্যাস জীবনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। ১৮ বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করেন। একজন ধর্মপ্রচারক  হিসেবে সিস্টার্স অফ লরেটো সংস্থায় যুক্ত হন। সেই যে পরিবার ছাড়লেন আর কোনদিনই পরিবারের সঙ্গে তাঁর দেখা হল না।
 
১৯২৯ সালে ভারতে এসে দার্জিলিঙে কাজ শুরু করেন। ১৯৩১ সালের ২৪ মে তিনি সন্ন্যাসিনী হিসেবে শপথ নিলেন। নাম পরিবর্তন করে রাখা হল টেরেসা। ১৯৩৭ সালের ১৪ই মে কলকাতার লরেটো কনভেন্ট স্কুলে পড়ানো শুরু করেন। সেই সময় কলকাতার দারিদ্র্যতা তাঁকে স্তম্ভিত করে তোলে। উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন মাদার। তারপরেই পঞ্চাশের মন্বন্তর, শহরে নেমে আসে মহামারি আর মৃত্যু মিছিল। ১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাতেও মারা যান বহু মানুষ। এই ঘটনাগুলি মাদারের মনে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। এরপরেই তিনি মানুষের কাজ করার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৪৮ সাল থেকে টেরেসা জনসাধারণের মধ্যে ধর্ম প্রচার করা শুরু করেন। ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। কলকাতার ১৪নং ক্রিক লেনের একটি ছোট ঘরকে কেন্দ্র করে শুরু হয় কর্মযজ্ঞ। ১৯৫০ সালের ৭ অক্টোবর কলকাতায় 'মিশনারিজ অব চ্যারিটি' প্রতিষ্ঠা করেন। মিশনারিজ অফ চ্যারিটি তৈরির সময় মাদার ১৩ জন সঙ্গীকে পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে অনাথ শিশুদের জন্যে তৈরি করেন শিশুভবন। ১৯৫২ সালে মাদার মুমূর্ষুদের জন্য প্রথম আশ্রয় ও সেবা কেন্দ্র গড়ে তোলেন। দরিদ্র্যদের চিকিৎসা দিতে কালিঘাট হোম ফর দ্য ডাইং তৈরি করেন। পরবর্তীতে যার নাম হয় নির্মল হৃদয়। 
 
মানুষের জন্য কাজ করার প্রথম দিনগুলি ছিল অত্যন্ত কষ্টকর। হাতে ছিল না অর্থ। আর্ত মানুষের খাবার ও থাকার অর্থের বন্দোবস্ত করতে তাঁকে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হত। পোশাক হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন নীল পাড়ের সাদা সুতির বস্ত্র। বস্তি এলাকায় কাজ শুরু করেন। স্কুল স্থাপনের মাধ্যমে পড়িয়েছেন, অসুস্থকে ওষুধ, ক্ষুধার্ত ও নিঃস্বদের আহার দিয়েছেন। 
 
প্রকৃত মা বলতে যা বোঝায় তিনি ঠিক তাইই। সারা বিশ্ব তাঁকে 'মা' বা 'মাদার' বলে চেনে। আজীবন অসংখ্য দুঃস্থ মানুষের সেবা করে গিয়েছেন। শহরের বস্তিতে বস্তিতে ঘুরে অনাথ, আস্তাকুঁড়ে পড়ে থাকা শিশুকে কোলে তুলে পরম মমতায়, ভালবাসা ছড়িয়ে দিয়েছেন। হাতটা জোড় করা, একটু ঝুঁকে হেঁটে যাওয়া সেই মা-ই যেন ভালবাসা ও মানবতার মূর্ত প্রতীক।
 
বর্তমানে তাঁর সংস্থার অধীনে ৪,০০০ এরও বেশি সন্ন্যাসিনী কাজ করছেন। কুষ্ঠরোগী, অনাথ ও এইডস আক্রান্তদের পরিবারের ভালবাসা দিয়েছেন মাদার। বিশ্বব্যাপী শরণার্থী, অন্ধ, পক্ষাঘাতগ্রস্ত, বয়স্ক, মাদকাসক্ত, দরিদ্র্য, বসতিহীন এবং বন্যা, দুর্ভিক্ষ বা মহামারিতে আক্রান্ত মানুষের সেবায় মিশনারিজ অফ চ্যারিটি কাজ করে। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে তাঁর চ্যারিটি হোম। ১৯৮৩ সালে রোম সফরের সময় তঁর প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয়। দ্বিতীয় বার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর তাঁর দেহে পেসমেকার বসে। এরপর তিনি নিউমেনিয়ায় আক্রাম্ত হন। ১৯৯৭ সালের ১৩ মার্চ মিশনারিজ অফ চ্যারিটির প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়ান মাদার। ওই বছরই ৫ সেপ্টেম্বর শেষ হয় তাঁর পার্থিব সফর।
 
২০১৬ সালে পোপ ফ্রান্সিস মাদারকে 'সন্ত' হিসেবে ভূষিত করেন। মাদার সেন্ট হয়েছে অনেক আগেই। অনেক দিন আগেই মাদারকে ঈশ্বরের আসনে বসিয়েছেন দক্ষিণ দিনাজপুরের মনিকা বেসরা। মনিকার দৃঢ় বিশ্বাস, মাদারের আশীর্বাদেই সেরে গিয়েছে তাঁর দুরারোগ্য ব্যধি।
সালটা ২০০৪, ৫ই সেপ্টেম্বর। তারিখটা লক্ষণীয়। মনিকার পেটে সেদিন অসহ্য যন্ত্রণা। পেটের যন্ত্রণা নিয়েও তিনি হাজির পতিরামের গির্জায়। প্রার্থনা চলাকালীন যন্ত্রণা আরও বাড়ে। সন্ন্যাসিনীদের ঘরে শুইয়ে দেওয়া হয় মনিকাকে। তাঁকে একটি লকেট পড়িয়ে দেওয়া হয়। লকেট পড়িয়ে দেওয়ার পর ঘুমিয়ে পড়েন মনিকা। চোখ খুলে দেখেন, আশ্চর্য কাণ্ড ঘটে গিয়েছে। পেটের যন্ত্রণা একেবারে সেরে গিয়েছে। সেদিনের কথা বলতে গেলে আজও চোখে জল আসে হরিরামপুরের দানগ্রামের মনিকা বেসরার। মাদার তাঁর কাছে ঈশ্বর। মনিকার বিশ্বাসে, মাদারের আশীর্বাদেই তিনি যন্ত্রণামুক্ত। মনিকার এই দাবির পরেই মাদারকে সেন্ট হুড দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। মাদারের অলৌকিক শক্তির স্বীকৃতি দিয়ে তাঁকে দেওয়া হচ্ছে সেইন্টহুড। কিন্তু মনিকার কাছে মাদার ঈশ্বর। যেমন গৌতম লুইসের কাছেও তিনি তাই। মাদারের জন্যেই স্বভাবিক জীবন, পরিবার পরিজন পেয়েছেন গৌতম। 
 
আজও সেবা ব্রত চালিয়ে যাচ্ছেন মাদার। ভারতের বাইরে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, রাশিয়া, পোল্যান্ডে ছড়িয়ে গিয়েছে তাঁর সেবা কেন্দ্র। গোটা বিশ্বে ৪৭০ টিরও বেশি সেবা কেন্দ্র রয়েছে তাঁর। ১২৪ টি স্কুল, ২২০টি দাতব্য চিকিৎসালয় আজও চালিয়ে যাচ্ছে তাঁর কর্মযজ্ঞ। মাদারের মৃত্যুর পরে কেটে গিয়েছে প্রায় আড়াই দশকেরও বেশি সময়, তাঁর সেবা ব্রত আজও তাঁকে মানুষের মনে বাঁচিয়ে রেখেছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...